

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। যে সৈকত একসময় বাংলার পর্যটনের প্রধান আকর্ষণ ছিল, আজ তা পরিণত হয়েছে বর্জ্যের ভাগাড়ে।
কোথাও ছেঁড়া জাল, কোথাও ফিস ফ্রাইয়ের বর্জ্য, ডাবের খোসা, প্লাস্টিকের বোতল, চায়ের টিস্যু–প্যাকেট, আর সবশেষে মানুষের মলমূত্র- সব মিলিয়ে সৈকতের পুরো পাঁচ কিলোমিটারজুড়ে ছড়ানো দুর্গন্ধে হাঁটতে পারছেন না পর্যটকেরা।
এ সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে অব্যবস্থাপনা, দখলবাজি, অবহেলা এবং বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির চরম অদক্ষতা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কলাতলী-বীচ থেকে লাবনী, সী-গাল থেকে সুগন্ধা- সবখানেই একই চিত্র। সৈকতে গিয়ে দেখা যায়- বালিয়াড়ি জুড়ে প্লাস্টিক ও পলিথিনের স্তুপ, ডেসটিনি বিল্ডিংয়ের দক্ষিণে ডাবের খোসার পাহাড়।
ডিভাইন রিসোর্ট থেকে সী-গাল পয়েন্ট পর্যন্ত হোটেলগুলোর নোংরা পানি সরাসরি সৈকতে পড়ছে, পচা ফিস ফ্রাইয়ের বর্জ্যে ছড়াচ্ছে বিষাক্ত দুর্গন্ধ, ডাস্টবিন থাকলেও বেশিরভাগই ভাঙা, অকার্যকর। টুরিস্ট পুলিশ বক্স ও জেলা প্রশাসনের তথ্য কেন্দ্রেরের পাশেই জমে আছে ময়লার স্তূপ।
গত বর্ষায় পাহাড়ি ঢলে কলাতলীর প্রধান প্রবেশপথ ভেঙে গেলে সেখানে চটের বস্তা দিয়ে অস্থায়ী ছড়া বানানো হয়েছিল। বর্ষা শেষ হলেও সেই ভাঙা রাস্তা আর মেরামত হয়নি। এখন সেখানেই জমছে বর্জ্য, জন্ম নিচ্ছে মশা-মাছির ঝাঁক।
প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক সৈকতে এলেও তাদের নিরাপত্তা, সৌন্দর্য ও পরিবেশ- কোনোটিরই দায় নিতে দেখা যাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে।
চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট থেকে পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসা আরিফুল ইসলাম বলেন, টিভিতে দেখে আসলাম, কিন্তু বাস্তবে এসে মনে হলো ময়লার ওপর দিয়ে হাঁটছি। সবচেয়ে বেশি দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে ফিস ফ্রাইয়ের বর্জ্য।
আরেক পর্যটক ইসরাত জাহান বলেন, ডাবের খোসা যেখানে-সেখানে ফেলা, পলিথিন-র্যাপার, টিস্যু- যেন পুরো সৈকতটাই ভাগাড়। হাঁটাও কষ্টকর।
কক্সবাজারে যারা নিয়মিত সৈকতের পরিচ্ছন্নতা তদারকি করেন- তাদেরই বক্তব্যে ফুটে উঠছে বিশৃঙ্খলার চিত্র।
পরিচ্ছন্ন কর্মীদের সুপারভাইজার মোহাম্মদ শামীম বলেন, লাবনী, কলাতলী ও সী-গাল পয়েন্টে মোট ৯টি ডাস্টবিন আছে, কিন্তু এগুলোর বেশিরভাগই নষ্ট। রাতের বর্জ্য ভোরে সরানো হয়, কিন্তু পর্যাপ্ত জনবল নেই।
তিনি আরও বলেন, সৈকত পরিষ্কারে ৪০ নারী কর্মী। এর মধ্যে কলাতলী- লাবনী অংশে কাজ করছে মাত্র ৩০ জন। সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ। নষ্ট ডাস্টবিনগুলো বছরের পর বছর মেরামত হয়নি, ফলে বালিয়াড়ি পরিণত হচ্ছে উন্মুক্ত ডাম্পিং জোনে।
পৌরসভার সচিব রাসেল চৌধুরী সাফ জানিয়ে দিলেন, সৈকতের ময়লার দায়িত্ব পৌরসভার নয়। তার দাবি, শহরের বর্জ্য অপসারণ করা হয়, কিন্তু সৈকত তাদের আওতার মধ্যে পড়ে না।
এ যেন দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার এক নির্মম বাস্তবতা। এমন অভিযোগ পর্যটকসহ সংশ্লিষ্টদের।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি সাংবাদিক দীপক শর্মা দীপু বলেন, বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির কাজই হচ্ছে সৈকতকে পরিচ্ছন্ন রাখা। কিন্তু তাদের কার্যক্রম শূন্যের কোঠায়। পর্যটন ব্যবসা থেকে বছরে কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব নেয়- সেই টাকা কোথায় যায়?
তিনি আরও বলেন, শুধু প্রশাসন নয়, স্থানীয় ব্যবসায়ী, দোকানি, হোটেল মালিক- সবাইকে সচেতন হতে হবে। নইলে বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকত একদিন নষ্ট হয়ে যাবে।
জানা গেছে, সুগন্ধা, কলাতলী ও লাবনী পয়েন্টের সাগরঘেঁষা হোটেলগুলোর কোনো স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি) নেই। ফলে- গোসল ও রান্নার পানি, ওয়াশরুমের বর্জ্য, রেস্টুরেন্টের তরল বর্জ্য- সবই সরাসরি পড়ছে সৈকতে এবং সাগরে।
এটি শুধু পরিবেশগত অপরাধ নয়, বরং মোবাইল কোর্টের আওতায় দণ্ডনীয়। কিন্তু বছরের পর বছরেও এসব হোটেলের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনো কার্যকর ব্যবস্থা।
সৈকত ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ, কমিটির কোনো তদারকি নেই, কোনো দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড নেই, বৈঠক হয় কাগজে-কলমে, কর্মকর্তারা দায়িত্ব ঠেলছেন একে অপরের ওপর।
সংশ্লিষ্টদের মতে, কক্সবাজারে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক আসেন। তাদের টাকায় গড়ে উঠেছে হাজারো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু সেই পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্ন সৈকত- সেটিই আজ সবচেয়ে অবহেলিত।
প্রশাসনের ব্যর্থতা, পৌরসভার দায় এড়িয়ে যাওয়া, বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির অচলাবস্থা, হোটেলগুলোর পরিবেশবিধি লঙ্ঘন- সব মিলিয়ে বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সৈকত আজ চরম হুমকির মুখে।
বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল মান্নান বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি দ্রুত পৌরসভা ও বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সঙ্গে বসবো। সৈকতকে পরিচ্ছন্ন রাখতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে অতীতে এমন আশ্বাস বহুবার এলেও বাস্তবে খুব কমই পরিবর্তন এসেছে।
মন্তব্য করুন