

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতীক যেমন দলকে চিহ্নিত করে, তেমনই বহু সময় তা হয়ে দাঁড়ায় ইতিহাসের সাক্ষী।
আজ যে প্রতীকগুলো নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, অতীতে তাদের সেই মালিকানা ছিল না।
যেমন, ‘নৌকা’ প্রতীক একসময় ছিল না আওয়ামী লীগের, আবার 'লাঙল' প্রতীকও একাধিক হাত বদলে এসেছে জাতীয় পার্টির দখলে।
১৯৫৪ সালের ৪ ডিসেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একাধিক বিরোধী দল একত্র হয়ে গঠন করেছিল ‘যুক্তফ্রন্ট’।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে এই রাজনৈতিক জোট তৈরি হয় শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী ও খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে।
১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে মুসলিম লীগ সরকারকে হারিয়ে দেয়।
এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট যে প্রতীক ব্যবহার করেছিল, তা ছিল ‘নৌকা’। জোটের প্রধান শক্তি ছিল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’।
জোট ভেঙে যাওয়ার পর এই প্রতীকটি থেকে যায় আওয়ামী মুসলিম লীগ দলের কাছে। ১৯৫৭ সালে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নাম হয় ‘আওয়ামী লীগ’। তখন থেকেই ‘নৌকা’ প্রতীকটিও হয়ে ওঠে তাদের নিজস্ব পরিচয়।
যদিও প্রতীকটি আগেই পাওয়া যায়, তবুও এই নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগ প্রথমবার নির্বাচন করে ১৯৭০ সালের পাকিস্তানি সাধারণ নির্বাচনে।
সে সময় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন দলটি এই প্রতীকে লড়াই করে এবং ১৬০টি আসনে জয় পায়।
বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদের মতে, আওয়ামী লীগ জোটের বৃহৎ দল হওয়ায় বাকিরা এই প্রতীকের মালিকানা দাবি করেনি, ফলে এটি দলটির নিজস্ব প্রতীক হয়ে যায়।
নদীমাতৃক দেশের প্রেক্ষাপটে ‘নৌকা’ ছিল গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের কাছে খুবই পরিচিত একটি প্রতীক। এ কারণে প্রতীকের প্রতি একটা স্বাভাবিক জনপ্রিয়তাও গড়ে ওঠে।
এরপর থেকে প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিংবা স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এই প্রতীকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এসেছে।
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে দলটির নিবন্ধন ও প্রতীক হিসেবে ‘নৌকা’র ব্যবহারের ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়।
বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের তালিকাতেও ‘নৌকা’ প্রতীকটি স্থগিত দেখানো হয়েছে।
বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে ‘লাঙল’ প্রতীকটিরও রয়েছে সমৃদ্ধ ও পটভূমিসম্পন্ন পথচলা। জাতীয় পার্টির আজকের প্রতীক হলেও, এর শুরু অনেক আগে— অবিভক্ত ভারতবর্ষের রাজনীতিতে।
শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির প্রতীক ছিল লাঙল। পরে পাকিস্তান আমলে এই প্রতীক চলে যায় আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় লীগের হাতে।
১৯৭০ সালের পাকিস্তানি সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় লীগ ‘লাঙল’ প্রতীকে অংশ নেয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আতাউর রহমান খান এই প্রতীকেই নির্বাচন করেন।
১৯৮৪ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে আতাউর রহমান প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন, এর কিছুদিন পরেই জাতীয় লীগ বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপর লাঙল প্রতীকটি চলে যায় এরশাদের জাতীয় পার্টির কাছে।
বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “আতাউর রহমান খান একসময় এরশাদের সঙ্গে জোট গড়েন এবং সরকারের অংশ হন। তখন থেকেই প্রতীকটি জাতীয় পার্টির হয়ে ওঠে।”
১৯৯০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত আটটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে জাতীয় পার্টি, প্রতিবারই ‘লাঙল’ প্রতীক ব্যবহার করে।
যদিও একাধিকবার দলটি বিভক্ত হয়েছে, ক্ষমতার বাইরে থেকেছে দীর্ঘদিন—তবুও প্রতীকের মালিকানা ধরে রেখেছে এরশাদের অনুসারীরা।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ফের জাতীয় পার্টি বিভক্ত হয়েছে। আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন অংশ আলাদা কাউন্সিল করে নতুন কমিটি গঠন করেছে এবং নির্বাচন কমিশনে ‘লাঙল’ প্রতীকের দাবি জানিয়েছে।
তবে এখনো নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ হালনাগাদ অনুযায়ী, লাঙল প্রতীক রয়েছে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নিয়ন্ত্রণাধীন অংশের কাছে।
নৌকা এবং লাঙলের গল্প শুধু দুটি রাজনৈতিক প্রতীকের পরিবর্তনের ইতিহাস নয়— এটি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতীকভিত্তিক উত্তরাধিকার ও জোটভাঙনের দলিলও বটে। প্রতীক যেখানে শুধু একটি চিহ্ন নয়, বরং জনমানসে একটি বিশ্বাস, এক ধরনের পরিচয় এবং রাজনীতির দীর্ঘ পথচলার প্রতিফলন।
সূত্র, বিবিসি
মন্তব্য করুন
