

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একধরনের স্থবিরতা ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন ট্যারিফ নিয়ে সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে দ্বন্দ্ব, ব্যাংক খাতে দেখা দিয়েছে তারল্য সংকট, আর পুঁজিবাজারে চলছে টানা দরপতন।
চলতি বছরের গত ২৮ কার্যদিবসে শেয়ারবাজারের সূচক কমেছে ৫৯২ পয়েন্ট। একই সঙ্গে রফতানি খাতেও দেখা যাচ্ছে মন্থর গতি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে যেখানে রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.৬৮ শতাংশ, সেখানে এবার তা নেমে এসেছে ৫.৬৪ শতাংশে।
মূল্যস্ফীতি এখনো উচ্চ পর্যায়ে রয়ে গেছে, যার প্রভাব পড়ছে অভ্যন্তরীণ চাহিদায়। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা মনে করছেন, চলতি অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে দেশের অর্থনৈতিক গতি আরও শ্লথ থাকবে এবং দীর্ঘস্থায়ী মন্দার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে আমদানি খাতের ধীরগতি। ‘মেজর ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস: মান্থলি আপডেট সেপ্টেম্বর, ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জুলাই মাসে পণ্য আমদানির পরিমাণ ছিল ৬২৭ কোটি ডলার, যা আগস্টে কমে দাঁড়িয়েছে ৫২২ কোটি ২৭ লাখ ডলারে। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রক্ষেপণ বলছে, মাসপ্রতি আমদানি ৪৬৫ থেকে ৪৬৭ কোটি ডলারে ঘোরাফেরা করবে, যা আমদানিতে স্থবিরতার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।
এই সময়ের ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি দায় দাঁড়াতে পারে ২.৬৯ বিলিয়ন ডলার, যা ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভের প্রায় ৫২ শতাংশের সমান। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা নিয়েও তৈরি হয়েছে চাপ।
বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের মতে, দেশের অর্থনীতিতে এখন এক ধরনের অপেক্ষারত অবস্থা বিরাজ করছে। নতুন বিনিয়োগে কেউই তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে, যা স্পষ্টতই নির্দেশ করে যে, উৎপাদন বা সম্প্রসারণমূলক তৎপরতা স্থবির। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত তারা ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ অবস্থান নেবেন।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কামরান তানভিরুর রহমান বলেন, নতুন কোনো বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে না। শুধু পূর্বে শুরু হওয়া কিছু সম্প্রসারণ প্রকল্পে কিছু কার্যক্রম চলছে। সামগ্রিকভাবে চাহিদা কমে গেছে, মূল্যস্ফীতি এখনো চেপে বসে আছে, মানুষ বুঝেশুনে খরচ করছে।
এমন মন্তব্য করেছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সংগঠনের নেতারাও। তাদের মতে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ব্যবসায়ীরা আস্থা হারাচ্ছেন, এবং এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে অর্থনীতির গতি ফিরে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, “যদিও এলসি খোলায় সামান্য ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেছে, কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে এই ধারা ধরে রাখা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত দ্রুত একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে ব্যবসায়িক পরিবেশে আস্থা ফিরিয়ে আনা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আমদানির প্রবণতায় ধস অর্থনীতির চাহিদা, বিনিয়োগ এবং প্রবৃদ্ধির দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, “জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আমদানির সম্ভাব্য ২৬ শতাংশ পতন অর্থনীতির গভীর মন্দা পরিস্থিতিকে তুলে ধরে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কৌশলগত নীতিমালা দরকার।
তিনি বলেন, “সরকারকে স্বল্পমেয়াদে কর-সুবিধা, সহজ শর্তে ঋণ ও কাঁচামাল-যন্ত্রাংশ আমদানিতে নীতিগত সহায়তা দিতে হবে। পাশাপাশি জনগণের ব্যয়ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতিতে সমন্বয় জরুরি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।
নির্বাচনের পর প্রস্তুতি নিতে বলছেন সাবেক অর্থনীতিবিদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী মনে করেন, “বর্তমানে যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, তা বিনিয়োগকারীদের আস্থা হরণ করছে। নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের জন্য এখন থেকেই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের রূপরেখা তৈরি করা জরুরি।
তিনি বলেন, অর্থনীতি রাজনীতির বাইরে কিছু নয়। অর্থনীতিকে রক্ষা করতে হলে এখন থেকেই সরকারকে প্রস্তুতি নিতে হবে। নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম শুরু করা যায়, সেই পরিকল্পনা থাকা দরকার।
মন্তব্য করুন
