

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে জন্ম নেওয়া প্রবল জলধারা চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পদ্মা নদী হয়েছে। আজ তা এক রুগ্ন স্মৃতি। একসময়ের খরস্রোতা পদ্মা এখন ধুঁকছে। এর প্রধান কারণ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ফারাক্কা ব্যারেজ।
অর্ধশতকে এ বাঁধের প্রভাবে পদ্মা নদীর পানির প্রবাহ কমেছে প্রায় ৭১ শতাংশ। এতে করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরবাসীর পরিবেশ, অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রা গভীর সংকটের মুখে পড়েছে।
১৯৭৫ সালে ভারতে সেচসহ বিভিন্ন কাজের জন্য গঙ্গা নদী থেকে পানি ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মিত হয়।
বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাজ্যের গবেষকদের ‘স্প্রিঙ্গার ম্যাগাজিন’-এ প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী ১৯৭৪ সালে (বাঁধের আগে) শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার পানি প্রবাহ ছিল প্রতি সেকেন্ডে ৩,৬৮৫ ঘনমিটার।
কিন্তু ২০২৪ সালের শুষ্ক মৌসুমে এই প্রবাহ নেমে এসেছে মাত্র ১,০৭৬ ঘনমিটারে। অর্থাৎ ৫০ বছরে পদ্মার মোট জলপ্রবাহ কমেছে ২৬০৯ ঘনমিটার, যা গড়ে ৭১ শতাংশ। বর্তমানে পদ্মায় মাত্র ২৯ শতাংশ পানি অবশিষ্ট আছে।
বিশেষজ্ঞরা এই বিপুল জল হ্রাসের মূল কারণ হিসেবে সরাসরি ফারাক্কা ব্যারেজকেই চিহ্নিত করেছেন। যা বাংলাদেশের পরিবেশের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। বর্ষা মৌসুম বাদে শুষ্ক মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মার বুকে শুধু ধু ধু বালুচর সৃষ্টি হয়। শুষ্ক মৌসুমে নৌ-চলাচলের পথ রুদ্ধ হওয়ায় চরবাসীকে মাইলের পর মাইল হেঁটে বালুচর পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে হচ্ছে। মালামাল পরিবহনে একমাত্র ভরসা এখন গরুর গাড়ি।
শিবগঞ্জ উপজেলার দুর্লভপুর ইউনিয়নের পাইপাড়ার বাসিন্দা আব্দুর রহিম বলেন, ‘‘আগের মতো পদ্মা তো নেই। কষ্ট করে হেঁটেই চরে যেতে হয়। নৌকার মাঝিরাও এখন পেশা বদলাচ্ছেন।’
নদীতে পানি ও মাছের পরিমাণ ব্যাপক হারে কমে যাওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে হাজার হাজার জেলে বেকার হয়ে পড়েছেন। মৎস্যজীবী সাইফুল ইসলামের মতো অনেকেই এখন মাছ না পেয়ে ঐতিহ্যবাহী পেশা ত্যাগ করে নতুন পথ খুঁজতে বাধ্য হচ্ছেন।
পদ্মা নদীর পানির স্তর কমে যাওয়ায় এর সংযুক্ত নদীগুলো যেমন মহানন্দা, আত্রাই, পুনর্ভবা ও বার্নাই নদীও পানিহীন হয়ে পড়ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোস্তফিজুর রহমান গবেষণা করে দেখেছেন, প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর তলদেশ দ্রুত ভরাট হচ্ছে। এর ফলে বর্ষায় নদী অতিরিক্ত পানি ধারণ করতে না পারায় বারবার বন্যা হচ্ছে।
নদী শুকিয়ে যাওয়ায় দীর্ঘমেয়াদী খরা সৃষ্টি হচ্ছে, যা কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও স্থানীয় জীবিকাকে বিপর্যস্ত করছে।
নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকীর মতে, ফারাক্কা ব্যারেজের কারণে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৮ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কারণ বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তার নির্ধারিত পানির ভাগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের প্রধান উদ্বেগ এখন ২০২৬ সাল ঘিরে, যখন ভারতের সঙ্গে গঙ্গা জলবণ্টন চুক্তি শেষ হচ্ছে। যদি আন্তর্জাতিক পানি-বণ্টন চুক্তি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন না হয় এবং বর্ষার পানি সংরক্ষণে বিকল্প উৎসের উন্নয়ন না করা যায়, তবে আগামীতে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি বড় অংশ ধীরে ধীরে মরুকরণে চলে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
অধ্যাপক মোস্তফিজুর রহমান সতর্ক করে বলেন, যদি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে একটি বিধ্বংসী পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। পদ্মাকে বাঁচাতে হলে জলবণ্টন চুক্তি কার্যকরভাবে নবায়ন ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি দ্রুত অভ্যন্তরীণ পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করা জরুরি।
যেখান থেকে আসে পদ্মার পানিপদ্মা নদী শুধু বাংলাদেশের একটি খরস্রোতা নদী নয়, এটি ভারত ও নেপাল থেকে নেমে আসা প্রায় অর্ধশত নদীর সম্মিলিত জলধারা এবং সমগ্র অঞ্চলের এক গুরুত্বপূর্ণ জীবনরেখা। হিমালয়ের বরফ ঠাণ্ডা পানির উৎস থেকে জন্ম নেওয়া এই নদীটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে ।
পদ্মা নদীর মূল উৎস হলো হিমালয় পর্বতমালার বরফ গলা জল। ভারতের উত্তরাখণ্ড ও উত্তর প্রদেশের বিশাল পাহাড়ে সারা বছর ধরে বরফ গলে যে পানির সৃষ্টি হয়, তাই গঙ্গা (ভারতে) হয়ে পদ্মা (বাংলাদেশে) নামে প্রবাহিত।
ভারতে এই গঙ্গা নদী প্রায় ২৫টি জেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে এবং এটি ভারতের মোট পানির চাহিদার চার ভাগের এক ভাগেরও বেশি যোগান দেয়। পদ্মা নদীর জলধারার প্রধান শক্তি আসে এর উপ-নদীগুলো থেকে।
আলোকানন্দা, রামগঙ্গা, কালিনাদী, ইয়ামুনা, গোমতী, কালী গান্দাক, কোশী এবং সোনে নদীর পানি গঙ্গা হয়ে পদ্মায় মিলিত হয়েছে। সব মিলিয়ে, ভারত ও নেপাল থেকে আসা প্রায় পঁচিশটি নদীর পানিপ্রবাহ নিয়ে পদ্মা বাংলাদেশে গড়িয়ে পড়ে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে প্রবেশ করার পর, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পদ্মার বিস্তার প্রায় ৩৫৭ কিলোমিটার। এটি রাজশাহী, পাবনা, ঢাকা এবং ফরিদপুরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এরপর দৌলতদিয়া-পাটুরিয়ায় এসে পদ্মা নদের সঙ্গে মিলিত হয় ব্রহ্মপুত্র নদ, যা তিস্তাসহ ভারত থেকে আরও প্রায় ১০টি নদীর জল বয়ে নিয়ে আসে।
এই বিশাল জলরাশি পরিবহন করে পদ্মা যখন চাঁদপুরের মেঘনা মোহনার দিকে ছুটে যায়, তখন এর পানির গতি শুধু আমাজন নদী থেকে পিছিয়ে থাকে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে মেঘনা মোহনা পর্যন্ত পদ্মার এই বিপুল জলধারা দেশের অর্থনীতি, কৃষি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ভূমিকা পালন করে চলেছে।
মন্তব্য করুন