

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


কক্সবাজারের ঈদগাঁও–ঈদগড়–বাইশারী সড়ক। সন্ধ্যা নামতেই নেমে আসে ভুতুড়ে নীরবতা। পাহাড়ি বাঁক পেরোতে পেরোতে পথিকের বুকের ধুকপুকানিও যেন বাড়তে থাকে। কারণ-এই সড়কের প্রতিটি মোড়, প্রতিটি ছায়া আর নীরবতার আড়ালেই লুকিয়ে থাকে ভয়: অপহরণ, ডাকাতি বা গুলিতে মৃত্যুর আশঙ্কা।
গত ১৫ বছরে এই সড়কে ঘটেছে তিন শতাধিক অপহরণ এবং পাঁচ শতাধিক ডাকাতির ঘটনা। কেউ মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসেছেন, কেউ ফিরেছেন পঙ্গু হয়ে; আর কেউ ফিরে এসেছেন কেবল কবরের মাটিতে।
স্বাধীনতার পর থেকেই সড়কটি অনিরাপদ হিসেবে পরিচিত। তবুও জীবিকার তাগিদে দিনে-রাতে হাজারো মানুষ বাধ্য হয়ে চলাচল করেন। স্থানীয়দের অভিযোগ-প্রশাসনের উপস্থিতি চোখে পড়ে খুব কম, টহলও অনিয়মিত। ফলে ঈদগাঁও, ঈদগড় ও বাইশারী—এই তিন ইউনিয়নের প্রায় এক লাখ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
ঈদগড় বাজার কমিটির সভাপতি নুরুল হুদা বলেন, “এই সড়কে যাতায়াত মানেই বুক ধড়ফড়ানি। কোন বাঁকে ডাকাত এসে দাঁড়াবে-কেউ জানে না।”
ভুক্তভোগী সুলায়মান বলেন, “এখানে জীবনের দাম মুক্তিপণের টাকার সমান। টাকা দিলে বাঁচা যায়, না দিলে জীবনটাই শেষ।”
স্থানীয়দের মতে, ডাকাতরা বেশির ভাগ সময় গাড়ির গতিরোধ করে যাত্রীদের অস্ত্র ঠেকিয়ে নামায়। লুট করে নগদ টাকা, মোবাইল, গয়না-আর সুযোগ পেলেই অপহরণ করে নিয়ে যায় পাহাড়ি জঙ্গলে। সেখানে চলে অমানবিক নির্যাতন। দিনের পর দিন আটকে রেখে দাবি করা হয় মুক্তিপণ। অনেক সময় দরকষাকষি জীবন বাঁচাতে ব্যর্থ হয়।
২০১২ সালের ভয়াবহ ঘটনায় বনী আমিন ও আবুবকর সিদ্দিককে অপহরণ করে তিন দিন জিম্মি রাখা হয়েছিল; মুক্তিপণ দিয়ে তারা বেঁচে ফেরেন। এরপর লেদু মিয়া, নুরুল আমিন, ২০১৯ সালে নুরুল হুদা, ২০২২ সালে রাশেদুল ইসলামসহ আরও অনেকে। সব ঘটনার কাহিনি প্রায় একই- আগে গুলি, তারপর অপহরণ, তারপর মুক্তিপণ।
২০২৫ সালেও চিত্র অপরিবর্তিত। বছরের শুরুতে মসজিদের ইমাম মিজানুর রহমানকে সকালে তুলে নেয় ডাকাতরা; মুক্তিপণ দিয়ে ২৪ ঘণ্টা পর মুক্তি পান। ব্যবসায়ী জাগের হোসেনও একইভাবে অপহৃত হন। এই সড়কে শুধু অপহরণ নয়, গুলিতে মৃত্যুর ঘটনাও ভয়াবহ।
২০২০ সালে ঈদগড় চরপাড়ার কিশোর শিল্পী জনি দে রাজ ডাকাতের গুলিতে নিহত হন; একই ঘটনায় মারা যান দিনমজুর কালু। এমনকি সরকারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও রেহাই পাননি-পানেরছড়া ঢালায় দায়িত্ব পালনকালে ডাকাতের গুলিতে নিহত হন ঈদগড় পুলিশ ক্যাম্পের নায়েক শুসময় চাকমা।
অপরাধ বাড়লেও তদন্ত, গ্রেপ্তার বা মামলার অগ্রগতি নেই বললেই চলে। থানায় সাধারণ ডায়েরি করতেও নাকি নানা অজুহাত শুনতে হয়।
সমাজকর্মী বনী আমিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এই সড়ক যেন ডাকাতদের স্বর্গরাজ্য। অপহরণের পর থানায় সহযোগিতা পাওয়া যায় না।”
স্থানীয়রা জানান, সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন করেও স্থায়ী সমাধান মিলছে না। কিছুদিন টহল বাড়লেও পরে আবার আগের অবস্থা ফিরে আসে। গত বছরের জুলাইয়ে সাততরা এলাকায় চারটি সিএনজি ও একটি গাড়ি ডাকাতির ঘটনাও সেই উদাহরণ।
এই সড়কে নিরাপত্তা ফেরাতে স্থানীয়দের প্রধান দাবি, হিমছড়ি ও পানেরছড়া এলাকায় সেনাবাহিনী বা বিজিবির স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন। পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার বা সেনা ক্যান্টনমেন্টের কথাও শোনা গেলেও বাস্তবায়ন হয়নি।
প্রবীণ শিক্ষক নুরুল ইসলাম বলেন, “আমরা যুগের পর যুগ আতঙ্কে বেঁচে আছি। সন্তানরা স্কুলে গেলে ফেরত আসবে কি না, এই ভয় সবসময় থাকে। এত হত্যাকাণ্ড আর অপহরণের পরও স্থায়ী সমাধান হয় না কেন বুঝি না।”
স্থানীয়দের মতে, এটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয় বরং দীর্ঘমেয়াদি সংগঠিত অপরাধচক্রের আধিপত্য। পাহাড়ঘেরা সড়ক, অন্ধকার, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক প্রভাব মিলিয়ে পথটি দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রুটে পরিণত হয়েছে।
ঈদগাঁও থানার ওসি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, “যোগদানের পরই পাহাড়ে অভিযান চালিয়েছি। টহল জোরদার করা হয়েছে। থানায় যে কোনো সেবা দিতে প্রস্তুত।”
রামু থানার ওসি আরিফ হোসেন বলেন, “ঈদগড়ের জনগণকে ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। প্রয়োজনে নিরাপত্তা দিয়ে বাসা থেকে তুলে এনে পৌঁছে দেওয়া হবে।”
মন্তব্য করুন
