সোমবার
১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সোমবার
১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কাফনের কাপড় পরে উচ্ছেদ অভিযান ঠেকাল শ্রমিকরা

কক্সবাজার প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০১:০৫ পিএম
অভিযানে নেতৃত্ব দেন পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিচালক জমির উদ্দিন ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিম
expand
অভিযানে নেতৃত্ব দেন পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিচালক জমির উদ্দিন ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিম

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মানিকপুরে পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের যৌথ অভিযানে তিনটি ইটভাটা ভেঙে দেওয়ার পর পাশের লামার ফাইতং এলাকায় শুরু হওয়া উচ্ছেদ অভিযান ঠেকাতে শত শত শ্রমিক কাফনের কাপড় পরে সড়কে শুয়ে পড়েন।

শ্রমিকদের এই জীবনঝুঁকিপূর্ণ প্রতিবাদের মুখে থেমে যায় অভিযান। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় শেষ পর্যন্ত প্রশাসন দুই দিনের জন্য অভিযান স্থগিত ঘোষণা করে এলাকা ত্যাগ করে।

এই ঘটনা শুধু প্রশাসনিক অভিযানের প্রতিরোধ নয়—দুই যুগ ধরে ইটভাটাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা প্রায় ২০ হাজার শ্রমজীবী মানুষের জীবিকার অস্তিত্ব সংকটের বহিঃপ্রকাশ।

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর অভিযোগ—অনুমোদনহীন এসব ইটভাটা বহু বছর ধরে পাহাড় কেটে মাটি সংগ্রহ করছে। এতে পাহাড়, বন, জীববৈচিত্র্য ও জলাধার ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

বনাঞ্চল থেকে অবৈধ কাঠ সরবরাহের অভিযোগও রয়েছে। পরিবেশকর্মীদের মতে, এসব ভাটা নিয়ন্ত্রণে না আনলে পাহাড়ধসসহ বড় ধরনের পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটতে পারে।

গত রোববার সকালে মানিকপুরে এএমবি–১, এএমবি–২ ও এএমবি–৩ নামের ঝিকঝাক চিমনিযুক্ত তিনটি ইটভাটা ভেঙে দেয় প্রশাসন। অভিযানে নেতৃত্ব দেন পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিচালক জমির উদ্দিন ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিম।

উপস্থিত ছিলেন বান্দরবান জেলা প্রশাসন, কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তর, র‍্যাব, পুলিশ ও আনসারের সদস্যরা।

ইটভাটা মালিকদের দাবি—এই তিনটি ভাটা ভেঙে দেওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ ১৫ কোটি টাকার বেশি।

মানিকপুরের অভিযান শেষে একই দল ফাইতং এলাকায় আরও কয়েকটি ইটভাটা উচ্ছেদের প্রস্তুতি নিলে বিক্ষোভ শুরু হয়।

দুপুর ১২টার দিকে শত শত শ্রমিক কাফনের কাপড় পরে সড়কে শুয়ে মৃত্যুকে সামনে রেখে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

সড়কে তাদের অবস্থান, কান্না–হাহাকার ও বিক্ষোভে প্রতিমিনিটে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। পাহাড়ি সড়ক সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।

এক শ্রমিক আব্দুল মান্নান বলেন, “ইটভাটা বন্ধ হলে আমরা কোথায় যাব? আমাদের বাঁচার আর কোনো পথ নেই। তাই আজ কাফন বেঁধেই রাস্তায় নেমেছি।”

অবরোধের কারণে অভিযানে অংশ নেওয়া কর্মকর্তাদের গাড়িবহর দীর্ঘ সময় আটকা পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে মনে করে প্রশাসন শেষ পর্যন্ত দুই দিনের জন্য অভিযান স্থগিত করে।

শ্রমিকদের দাবিতে জানা যায়—চকরিয়ার মানিকপুরের পাঁচটি ও ফাইতং এলাকায় ২৫টির বেশি ইটভাটায় প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। শুধু শ্রমিক নয়—মাটি সরবরাহকারী, কাঠ–কয়লা ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক, হোটেল কর্মচারীসহ কমপক্ষে ৫০ হাজার মানুষ পরোক্ষভাবে এসব ভাটার ওপর নির্ভরশীল।

একজন জ্যেষ্ঠ শ্রমিক বলেন, “শত শত পরিবার ভাটার পাশে ঘর করে থাকে। আমাদের শিশুদের স্কুল, খাবার, পোশাক—সবই এই ভাটার আয়ে চলে।”

তার মতে, চকরিয়া, পেকুয়া ও মহেশখালী এলাকার নির্মাণকাজের বড় অংশের চাহিদা মেটায় মানিকপুর–ফাইতংয়ের ইটভাটা।

ব্যক্তিগত ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে মসজিদ–মাদ্রাসা, বাজার, সেতু, রাস্তা—সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি নির্মাণকাজে ব্যবহৃত হয় এসব ইট।

মালিকদের অভিযোগ—হঠাৎ ভাটা ভেঙে দিলে স্থানীয় নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যাবে, ইটের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়বে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ মানুষ।

পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে—ঝিকঝাক চিমনি অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং এসব ভাটা সম্পূর্ণ অবৈধ।

অন্যদিকে শ্রমিকদের যুক্তি—পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে রূপান্তরের জন্য মালিকদের সময় ও সহায়তা দেওয়া উচিত, সরাসরি ধ্বংস করে দিলে হাজারো পরিবার পথে বসবে।

এক শ্রমিক নেতা বলেন, “আমরা পরিবেশ নষ্টের পক্ষে নই। কিন্তু একদিনে ২০ হাজার শ্রমিককে বেকার করে দিলে তারা বাঁচবে কীভাবে?”

স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে—পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আইন অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

তবে শ্রমিকদের বার্তা স্পষ্ট—উচ্ছেদ মানে বেকারত্ব, আর বেকারত্ব মানে মৃত্যু। তাই তারা কাফনের কাপড় জড়িয়ে সড়কে শুয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন।

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন