

গাজা যুদ্ধে ইতি টানতে ২০ দফা শর্ত দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুদ্ধরত ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের তরফে সেই প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে এসেছে। যদিও পশ্চিম এশিয়ার এই আপাত শান্তির আড়ালে উঁকি দিচ্ছে একটি প্রশ্ন।
সংঘর্ষ বন্ধ করার নামে ভূমধ্যসাগরের কোলের সম্পূর্ণ গাজা এলাকাটিকেই গিলে নিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট? ফলে সেখানে শান্তি কত ক্ষণ স্থায়ী হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান বিশ্লেষকদের একাংশ।
গাজা নিয়ে ট্রাম্প ২০ দফা প্রস্তাব দিতেই তার চুলচেরা বিশ্লেষণে লেগে পড়েন দুনিয়ার দুঁদে কূটনীতিকেরা। তাঁদেরই একাংশের যুক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যেটা করছেন তাতে পশ্চিম এশিয়ায় দীর্ঘকালীন শান্তি ফেরার সম্ভাবনা খুবই কম। উল্টে ঝাঁ-চকচকে শহর তৈরির নামে গাজাবাসীদের সেখান থেকে তাড়াতে চাইছেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, শর্ত অনুযায়ী প্যালেস্টাইনের ওই জমিও বকলমে চলে যাবে আমেরিকা ও ইজরায়েলের কব্জায়। পাশাপাশি, বিলুপ্তি ঘটবে সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ট্রাম্পের তৈরি করা শান্তি প্রস্তাবের সবচেয়ে বিতর্কিত জায়গাটি হল ‘বোর্ড অফ পিস’। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কথা অনুযায়ী, যুদ্ধ বন্ধ করার শর্তগুলি ঠিকমতো পালন হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য তৈরি হবে ওই বোর্ড। এর মাথায় থাকবেন স্বয়ং ট্রাম্প এবং সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। এই দু’জনের কেউই প্যালেস্টাইনপন্থী নন। বরং দু’জনের সঙ্গেই ইজরায়েলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ফলে বোর্ডের সিদ্ধান্ত একমুখী হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের ২০ দফা প্রস্তাবে গাজা থেকে হামাসের যাবতীয় হাতিয়ার এবং গুপ্তঘাঁটিগুলিকে সরিয়ে ফেলার উল্লেখ রয়েছে। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্যালেস্টাইনের ওই জমিতে তৈরি হবে একটি অস্থায়ী এবং অরাজনৈতিক সরকার। এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন প্যালেস্টাইনি এবং বিশ্বের নানা প্রান্তের বিশেষজ্ঞরা। যদিও কারা এই সুযোগ পাবেন, তা স্পষ্ট করেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তবে সংশ্লিষ্ট অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের তদারকির জন্য একটি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী গঠনের কথা বলেছেন তিনি।
মজার বিষয় হল ওই আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীরও মাথায় থাকবেন ট্রাম্প এবং টনি ব্লেয়ার। পাশাপাশি, গাজার ভবিষ্যৎ পরিচালন পদ্ধতিতে হামাসের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনও যোগ থাকবে না বলে ঘোষণা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সেখানে একটি আন্তর্জাতিক সুরক্ষা বাহিনীকে মোতায়েন করার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। এরা স্থানীয় পুলিশকে প্রশিক্ষণ দেবে। কূটনীতিকদের যুক্তি, এর অর্থ হল গাজার প্রশাসনিক এবং সামরিক নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে।
তৃতীয়ত, শান্তি প্রস্তাবে গাজার পুনর্নির্মাণে জোর দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তাঁর সাফ কথা, সেখানকার বাসিন্দাদের কেউ জোর করে উৎখাত করবে না। যাঁরা গাজা ছাড়তে চাইছেন, তাঁরা অন্যত্র যেতে পারেন। আবার যাঁরা গাজাতেই থাকতে ইচ্ছুক, তাঁদেরও কোনও সমস্যা হবে না। ওই এলাকায় শান্তি ফিরলে গাজ়ার শাসনভার প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়ার কথা শান্তি সমঝোতায় বলা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও আছে শর্ত। এর জন্য অন্তর্বর্তী সংস্কারের রাস্তায় হাঁটতে হবে প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষকে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, গাজা প্রস্তাব কার্যকর করতে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ‘বন্ধু’ দেশগুলিকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক সুরক্ষা বাহিনী তৈরি করবেন ট্রাম্প। প্যালেস্টাইনের ওই জমিতে তাঁদের নিয়ে যাবে ‘ইজরায়েল ডিফেন্স ফোর্স’ বা আইডিএফ। পরবর্তী পর্যায়ে তাঁদের একমাত্র কাজ হবে হামাসের গুপ্তঘাঁটি ধ্বংস করা। তবে সশস্ত্র গোষ্ঠীটির যোদ্ধাদের অন্যত্র চলে যাওয়ার সুযোগ দেবেন তাঁরা। এর জন্য গাজ়ায় কত দিন ইহুদি বাহিনী থাকবে, তা একেবারেই স্পষ্ট নয়।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, গাজায় আন্তর্জাতিক সুরক্ষা বাহিনী ঢুকলে শক্তিবৃদ্ধি হবে ইজরায়েলের। তখন হামাস-যোদ্ধাদের ওই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র যাওয়া ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা থাকবে না। আর এ ভাবেই শান্তিপ্রস্তাবের আড়ালে ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী প্যালেস্টাইনের জমি কব্জা করতে চাইছেন ট্রাম্প। ওই এলাকাটিকে বড় বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। ক্ষমতায় থাকাকালীন সেই প্রক্রিয়া শুরু করে দিতে চান তিনি।
গত কয়েক দশকে অত্যাধুনিক শহর হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে পশ্চিম এশিয়ার একাধিক জায়গা। এর জেরে কোটি কোটি ডলারের বিনিয়োগ টানতে পেরেছে ওই এলাকার একাধিক দেশ। উদাহরণ হিসাবে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির দুবাই, আবু ধাবি এবং শারজার কথা বলা যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট তালিকায় নাম রয়েছে কাতারের রাজধানী দোহারও। ঠিক একই কায়দায় গাজ়ার পুনর্নির্মাণ করতে চাইছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
অবস্থানগত দিক থেকেও গাজার একটা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। প্যালেস্টাইনভূমিটির এক দিকে ভূমধ্যসাগর ও ইউরোপ, দক্ষিণে মিশর ও আফ্রিকা এবং পূর্বে এশিয়া। ফলে একে বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে পারলে যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রভূত লাভ হবে, তা বলাই বাহুল্য। বর্তমানে হংকং এবং ম্যাকাওয়ের নিয়ন্ত্রণ হাতে থাকায় আর্থিক ও বাণিজ্যিক দিক থেকে ফুলেফেঁপে উঠতে পারছে চিন। ট্রাম্পও ঠিক একই কায়দায় গাজ়াকে ব্যবহার করতে চাইছেন বলে মনে করেন কূটনীতিকেরা।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই স্বপ্নে সবচেয়ে বড় বাধার জায়গা হল হামাস। প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীটি তাঁর দেওয়া প্রস্তাব পুরোপুরি মেনে নিয়েছে, এমনটা নয়। তাঁদের দাবি, জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে ইসলামীয় এবং আরব দেশগুলির দ্বারা সমর্থিত কোনও স্বাধীন প্যালেস্টাইনপন্থী সংস্থার হাতে গাজার প্রশাসনিক ক্ষমতা তুলে দেওয়া হোক। তা ছাড়া সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ নিয়েও কোনও মন্তব্য করেনি হামাস।
২০০৬ সালের নির্বাচনে জিতে গাজার ক্ষমতা দখল করে হামাস। ওই সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ফাতাহ্কে ক্ষমতাচ্যুত করে তারা। আর তাই সেখানে শান্তি ফেরাতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি চালু রাখার পাল্টা দাবি ট্রাম্পের সামনে রাখতে পারে এই প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী। সে ক্ষেত্রে ভোটে অংশ নেওয়ার অধিকার থাকবে হামাসের। ফলে কোনও অবস্থাতেই সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীটিকে ‘নির্মূল’ করতে পারবেন না যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
গাজ়া নিয়ে ট্রাম্পের ২০ দফা প্রস্তাবের বেশ কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হল, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ইজরায়েলি পণবন্দিদের মুক্তি। গত দু’বছর ধরে এরা রয়েছে হামাসের কব্জায়। উল্টো দিকে ইহুদিভূমিতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ২৫০ জন প্যালেস্টাইনপন্থীকে মুক্তি দেবে তেল আভিভ।
এ ছাড়া, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যত গাজাবাসী গ্রেফতার হয়েছে, তাঁদেরও ছেড়ে দেবে ইজরায়েল। এই শর্ত মেনে নিয়ে বিবৃতি জারি করেছে হামাস।
প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীটি জানিয়েছে, ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী গাজা থেকে জীবিত ও মৃত সমস্ত পণবন্দিকে মুক্তি দেবে তাঁরা। তবে কিছু শর্ত রয়েছে। সেগুলি কী, তা স্পষ্ট করেনি হামাস। মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবে গাজা থেকে দফায় দফায় ফৌজ প্রত্যাহারের কথা রয়েছে ইজরায়েলের। ওই সময় বন্দিমুক্তির প্রক্রিয়া চালাবে যুযুধান দু’পক্ষ। তবে আপাতত ইহুদিরা প্যালেস্টাইনভূমিতে কোনও বোমাবর্ষণ বা হামলা চালাবে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন ট্রাম্প।
এই প্রস্তাবকে হামাস স্বাগত জানাবে বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ, গাজা থেকে ইজরায়েলি বাহিনী পিছু হটুক, তা প্রথম দিন থেকে চেয়ে এসেছে তাঁরা। ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী, অবিলম্বে প্যালেস্টাইনভূমিতে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হবে। সরিয়ে ফেলা হবে ধ্বংসপ্রাপ্ত কাঠামো। তার পর শুরু হবে পুনর্নির্মাণের কাজ। এর প্রথম পর্যায়ে থাকবে হাসপাতাল ও রাস্তাঘাট নির্মাণ। রাষ্ট্রপুঞ্জ, রেড ক্রেসেন্ট এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এই গঠনমূলক কাজ করুক, চাইছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আরও একটি কারণে গাজ়াকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন ট্রাম্প। গত সেপ্টেম্বরে কাতারের রাজধানী দোহায় বিমান হামলা চালায় ইজরায়েলি বায়ুসেনা। সেখানে হামাস নেতৃত্বের বৈঠকে বসার কথা ছিল। ওই সময় আচমকাই আকাশপথে আক্রমণ শানিয়ে তাঁদের উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ইহুদি বিমানবাহিনী। পশ্চিম এশিয়ার সবচেয়ে বড় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে কাতারে। কিন্তু তেল আভিভের হামলার সময় সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজ।
ওই ঘটনার পরই ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সুর চড়াতে থাকে কাতার। ইহুদি ‘আগ্রাসন’ ঠেকাতে ঘন ঘন ইসলামীয় দেশগুলির সঙ্গে বৈঠক করতে দেখা যায় তাদের। এই আবহে গত ১৭ সেপ্টেম্বর একটি প্রতিরক্ষা চুক্তিতে আবদ্ধ হয় সৌদি আরব ও পাকিস্তান। সেই সমঝোতায় এক পক্ষ আক্রান্ত হলে দু’টি দেশের জন্যেই তা যুদ্ধ হিসাবে বিবেচিত হওয়ার কথা বলা রয়েছে। পাশাপাশি, রিয়াধকে ‘আণবিক সুরক্ষা’র প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইসলামাবাদ।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, আগামী দিনে পাকিস্তানের সঙ্গে এই ধরনের প্রতিরক্ষা চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারে পশ্চিম এশিয়ার আরও কিছু দেশ। ইজ়রায়েলের নিরাপত্তার জন্য যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। আর তাই গাজায় সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে তেল আভিভের পাশে থাকতে চাইছেন ট্রাম্প। সে ক্ষেত্রে ইহুদিভূমিকে নিশানা করতে আরব দেশগুলিকে যে দু’বার ভাবতে হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
ট্রাম্পের দেওয়া ২০ দফা প্রস্তাবের পর অবশ্য হুঙ্কারের সুর শোনা গিয়েছে ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর গলায়। হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘হামাস যদি এই শর্ত মেনে নেয়, তা হলে ভাল। কিন্তু যদি প্রস্তাব মানা না হয়, তা হলে আমরা যাবতীয় পরিকল্পনাকে সম্পূর্ণ করব।’
এককথায় শক্তির নিরিখেই গাজায় শান্তি স্থাপন করার মরিয়া চেষ্টা করছেন ট্রাম্প। এতে লাভের পাল্লা সম্পূর্ণ ঝুঁকে থাকছে ইজরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। নিজেদের অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে শেষ পর্যন্ত হামাস এতে কতটা রাজি হয়, সেটাই এখন দেখার।
সূত্র: আনন্দবাজার
মন্তব্য করুন