

দলীয় পর্যবেক্ষণ ও মাঠপর্যায়ের প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে কয়েকটি আসনে বিএনপির প্রার্থী পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। দলটি ইতোমধ্যে ২৩৮টি আসনে সম্ভাব্য একক প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে, তবে কিছু এলাকায় বিরোধ ও অসন্তোষের কারণে পুনর্মূল্যায়নের প্রক্রিয়া চলছে।
ঘোষিত প্রার্থীদের কার্যক্রম এবং স্থানীয় পর্যায়ের সংগঠনের ঐক্য পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বিএনপি।
বিশেষ করে মনোনয়ন না পাওয়া ত্যাগী নেতাদের সঙ্গে মনোনীত প্রার্থীদের সম্পর্ক ও আচরণ মূল্যায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ঐক্য নষ্টের অভিযোগে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও প্রস্তুতি রয়েছে দলের।
দলের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, অন্তত ২০টিরও বেশি আসনে মনোনয়ন নিয়ে তীব্র মতভেদ তৈরি হয়েছে। কিছু এলাকায় বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। দলীয় হাইকমান্ডের ধারণা, পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে কয়েকজন বঞ্চিত নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন।
দলীয় সূত্র জানায়, ঘোষিত প্রার্থীদের মাঠপর্যায়ের জনপ্রিয়তা নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা হচ্ছে। যাচাই–বাছাইয়ের ফলাফলের ওপর নির্ভর করে প্রাথমিক তালিকায় কিছু পরিবর্তন আসতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, “কিছু আসনে ক্ষোভ থাকতেই পারে। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছি। ফাঁকা আসনগুলোর সবই মিত্রদের জন্য থাকবে না; এর কিছুতে আমাদেরও প্রার্থী ঘোষণা করা হবে।”
গত ৩ নভেম্বর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩৭ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেন। তিনি জানান, এটি প্রাথমিক তালিকা—চূড়ান্ত নয়। শরিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে আসন ভাগাভাগি ও প্রার্থী পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ঘোষণার পর থেকেই সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, কক্সবাজার, নাটোর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ একাধিক জেলায় মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা বিক্ষোভ ও প্রার্থী পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে আসছেন। কয়েকটি স্থানে দুই পক্ষের সংঘর্ষ ও আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
দলের নীতিনির্ধারকদের মতে, কিছু যোগ্য ও জনপ্রিয় নেতা এবার মনোনয়ন পাননি, যাদের প্রতি অন্য রাজনৈতিক দলগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছে। এ কারণে ভোট বিভাজনের ঝুঁকি বিবেচনায় বিএনপি কিছু আসনে পুনর্বিবেচনার পথে হাঁটতে পারে।
এ ছাড়া ফাঁকা থাকা ৬৩টি আসনের মধ্যে অন্তত ১১টিতে দলীয় প্রার্থী ঘোষণার প্রস্তুতি চলছে। সূত্রে জানা গেছে, এর মধ্যে ঢাকা-৯, ঢাকা-১৮, গাজীপুর-১, টাঙ্গাইল-৫, চট্টগ্রাম-৬, চট্টগ্রাম-৯, চট্টগ্রাম-১১, ঝিনাইদহ-৪, মাদারীপুর-২ ও সিরাজগঞ্জ-১ আসন থাকতে পারে।
ঘোষিত আসনের মধ্যে অন্তত ২৩টিতে শক্ত অবস্থানে রয়েছেন মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা। কয়েকজন দলীয় মনোনয়ন না পেলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন বলে আভাস পেয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। এসব আসনে সম্ভাব্য একক প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ চলছে। সংঘর্ষে নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
সাতক্ষীরা-২ (সদর-দেবহাটা) আসনে বিএনপির প্রার্থী আবদুর রউফের মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বরাবর আবেদন করেছেন সদর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের ৩৩ জন নেতা। বৃহস্পতিবার তারা যৌথভাবে এ আবেদন করেন। এ আসনে আব্দুল আলিমকে ত্যাগী নেতা বলে উল্লেখ করে তার মনোনয়নের দাবিতে বিক্ষোভ ও মশাল মিছিলও করেছে দলের একাংশ। একইভাবে সাতক্ষীরা-৩ (কালীগঞ্জ-আশাশুনি) আসনে ‘গরিবের বন্ধু’ নামে পরিচিত ডা. শহিদুল আলমকে মনোনয়ন না দিয়ে সাবেক সংসদ-সদস্য কাজী আলাউদ্দীনকে মনোনয়ন দেওয়ার প্রতিবাদে কালীগঞ্জে বিএনপির একাংশ বিক্ষোভ মিছিল করেছে।
ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনে মনোনয়ন পাওয়া এম ইকবাল হোসেইন ও মনোনয়নবঞ্চিত নেতা আহম্মেদ তায়েবুর রহমানের সমর্থকরা রোববার পৌর শহরের মধ্য বাজার এলাকায় সংঘর্ষে জড়ান। এতে উভয়পক্ষের অন্তত আটজন আহত হন। আহম্মেদ তায়েবুর রহমান এলাকার প্রভাবশালী নেতা হিসাবে পরিচিত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ (নবীনগর) আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছে উপজেলা দলের এক পক্ষের অনুসারীরা। তারা আবদুল মান্নানের মনোনয়ন পুনর্বিবেচনা করে নাজমুল হোসেনকে মনোনয়ন দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (আখাউড়া-কসবা) আসনেও সম্ভাব্য প্রার্থী পুনর্বিবেচনার দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তারা অবিলম্বে মনোনয়ন পরিবর্তন করে ত্যাগী ও মাঠপর্যায়ে গ্রহণযোগ্য নেতা কবীর আহমেদ ভূঁইয়াকে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
সিলেট-৪ (গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুর) আসনে জেলা বিএনপির উপদেষ্টা আবদুল হাকিম চৌধুরীকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবিতে গোয়াইনঘাটের নয়াবাজারে বিএনপির হাজারো নেতাকর্মী মশাল মিছিল করেছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ (ভোটাহাট, গোমস্তাপুর ও নাচোল) আসনেও মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে।
ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া) আখতারুল আলমের মনোনয়ন বাতিল করে সাবেক ছাত্রনেতা আব্দুল করীম সরকারকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবিতে গণমিছিল ও বিক্ষোভ করেছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। হবিগঞ্জ-৪ (চুনারুঘাট-মাধবপুর) আসনে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া এসএম ফয়সালকে পরিবর্তন করে শাম্মী আক্তারকে প্রার্থী করার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন উপজেলা ও পৌর ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা।
রংপুর-৩ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী পুনর্বিবেচনার দাবিতে গণমিছিল হয়েছে। রংপুর মহানগরীতে এ মিছিলে অংশ নেন দলের সদস্য সচিব মাহফুজ উন নবীর সমর্থকরা। এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু।
কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরীর মনোনয়ন পরিবর্তন মোহাম্মদ আবদুল্লাহকে দলের প্রার্থী ঘোষণার দাবিতে টেকনাফ পৌরসভায় বিক্ষোভ মিছিল করেছেন দলটির একাংশ। দলের মনোনয়নবঞ্চিত জেলা বিএনপির অর্থ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল্লাহর সমর্থকরা এই মশাল মিছিল বের করেন।
নাটোর-১ (লালপুর-বাঘাতিপাড়া) আসনে প্রার্থী করা হয়েছে প্রয়াত বিএনপি নেতা ফজলুর রহমান পটলের মেয়ে ফারজানা শারমিন পুতুলকে। এ আসনে আরও দুজন মনোনয়নপ্রত্যাশী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু এবং পুতুলের ভাই ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক ভিপি ইয়াছির আরশাদ রাজন। পুতুলের প্রার্থিতা ঘোষণার পর থেকে টিপু ও রাজন সমর্থকরা পৃথকভাবে বিক্ষোভ করছেন। রোববারও বাগাতিপাড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক বিশাল সমাবেশও করেন টিপু।
নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনে ঘোষিত সম্ভাব্য প্রার্থীর বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছেন মনোনয়নবঞ্চিরা। সোমবার আড়াইহাজারে ৭ নভেম্বর উপলক্ষ্যে আলোচনা সভায় একই মঞ্চে মনোনয়নবঞ্চিত কেন্দ্রীয় নেতা মাহমুদুর রহমান সুমন, সাবেক সংসদ-সদস্য আতাউর রহমান আঙ্গুর ও মহিলা দলের কেন্দ্রীয় নেত্রী পারভিন আক্তারকে দেখা যায়।
মেহেরপুর-২ (গাংনী) আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী আমজাদ হোসেন। তার পরিবর্তে জেলা বিএনপির সভাপতি জাভেদ মাসুদকে প্রার্থী করার দাবিতে আন্দোলন করছেন নেতাকর্মীদের একাংশ।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরীকে প্রার্থী না করায় চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি তুলেছেন সেখানকার নেতাকর্মীদের একাংশ। এই আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসাবে মনোনীত চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন।
চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কর্নেল (অব.) আজিম উল্লাহ বাহারকে মনোনয়ন না দেওয়ায় সড়কে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছেন তার সমর্থকরা। নরসিংদী-৪ আসনে সর্দার সাখাওয়াত হোসেন বকুলকে মনোনয়ন দেওয়ায় সেখানেও ক্ষুব্ধ হয়েছেন বেশকিছু স্থানীয় নেতাকর্মী। তারা বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। একই অবস্থা মুন্সীগঞ্জ-২ আসনেও। সেখানেও বিএনপির প্রার্থী পুনর্বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদকে প্রার্থী করার দাবিতে বিক্ষোভ করছে। এসব আসনের বাইরে চট্টগ্রাম-১৬, নোয়াখালী-৫, ঠাকুরগাঁও-৩, রাজশাহী-৪ ও ৫ আসনসহ বেশ কয়েকটিতে মনোনয়ন নিয়ে কিছুটা অসন্তোষ রয়েছে।
এসব আসনে প্রার্থী পরিবর্তন করা হবে কিনা সেটি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে হাইকমান্ড। এদিকে ফাঁকা ৬৩ আসনের মধ্যে অন্তত ১১ আসনে দলীয় প্রার্থী শিগগিরই ঘোষণা দেওয়া বলে জানা গেছে।
মন্তব্য করুন