


বিশ্ব অর্থনীতি আজ এক অনিশ্চিত সময়ের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক মন্দা, ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা এবং প্রযুক্তিগত বিপ্লব; সব মিলিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ আরও জটিল হয়ে উঠেছে। এই বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যে বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে, গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে সাম্প্রতিক বাস্তবতা আমাদের সামনে নতুন প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে।
বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, বিনিয়োগের ঘাটতি, বেকারত্বের চাপ এবং জলবায়ু ঝুঁকি; সব মিলিয়ে অর্থনীতির ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে উঠছে। শুধু জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোই সমাধান নয়; প্রয়োজন একটি ন্যায়ভিত্তিক ও টেকসই অর্থনৈতিক কাঠামো, যেখানে পরিবেশ, সমাজ এবং শাসনব্যবস্থা সমান গুরুত্ব পাবে। এই লক্ষ্য অর্জনে Triple Accountability Theory for Planetary Justice (TAP-J) বা ত্রৈমাসিক দায়বদ্ধতা তত্ত্ব হতে পারে একটি কার্যকর দিকনির্দেশনা। এই তত্ত্বের মূল দর্শন হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে এমনভাবে, যাতে পরিবেশের ক্ষতি না হয়, কেউ বাদ না পড়ে, এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা উপেক্ষিত না হয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে একাধিক গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রথমত, বিনিয়োগের সংকট। বৈদেশিক বিনিয়োগ (FDI) ধারাবাহিকভাবে কমছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে এফডিআই প্রবাহ প্রায় ১৫% হ্রাস পেয়েছে। এর পেছনে অবকাঠামোগত দুর্বলতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম বড় ভূমিকা রাখছে। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে। দ্বিতীয়ত, শ্রমবাজারের চাপ। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ নতুন কর্মশক্তি শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে, কিন্তু পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। এর ফলে যুব বেকারত্বের হার ১২% ছাড়িয়েছে। বিশেষ করে প্রযুক্তি ও শিল্প খাতে দক্ষতার ঘাটতি সমস্যাকে আরও জটিল করছে। উদাহরণস্বরূপ, গার্মেন্টস খাতে অটোমেশন বাড়লেও শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নের উদ্যোগ সীমিত থাকায় অনেকেই চাকরি হারাচ্ছেন।
তৃতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন এবং লবণাক্ততা কৃষি উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপি ৯% পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ইতিমধ্যেই দক্ষিণাঞ্চলের অনেক কৃষক লবণাক্ততার কারণে জমি চাষাবাদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। সবশেষে, আয়ের বৈষম্য নিয়ে কথা বলা জরুরি। ধনী-গরিবের ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে। বর্তমানে জিনি সহগ (Gini Coefficient) প্রায় ০.৪৮, যা সামাজিক অস্থিরতার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। শহর ও গ্রামের মধ্যে আয় বৈষম্য স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। এর ফলে সামাজিক অসন্তোষ ও অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, রাজধানী ঢাকায় মাথাপিছু আয় দ্রুত বাড়লেও গ্রামীণ অর্থনীতি এখনও পিছিয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে টেকসই ও ন্যায়ভিত্তিক করতে Triple Accountability Theory for Planetary Justice (TAP-J) একটি নতুন দিকনির্দেশনা হতে পারে। এই তত্ত্ব তিনটি মূল নীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, তা হলো শূন্য ক্ষতি (Zero Harm), শূন্য বঞ্চনা (Zero Exclusion) এবং শূন্য অবহেলা (Zero Neglect)। এগুলো শুধু কর্পোরেট দায়বদ্ধতার জন্য নয়, বরং জাতীয় অর্থনৈতিক নীতির জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য।
Zero Harm বা শূন্য ক্ষতি নীতির মূল লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেন পরিবেশের ক্ষতির বিনিময়ে না হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ওপর নির্ভরশীলতা এখনও বেশি, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। অথচ ভারত ও চীন নবায়নযোগ্য শক্তিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। বাংলাদেশকেও সৌর ও বায়ু শক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, গ্রামীণ শক্তি ইতিমধ্যেই ৫০ লাখের বেশি সৌর হোম সিস্টেম স্থাপন করেছে, যা গ্রামীণ বিদ্যুতায়নে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এই মডেলকে শিল্প খাতে সম্প্রসারণ করা গেলে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারে বড় অগ্রগতি সম্ভব।
Zero Exclusion বা শূন্য বঞ্চনা নীতির লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেন সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করে। বর্তমানে নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ মাত্র ৩৬%, এবং প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীও পিছিয়ে আছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য শর্ত রাখতে হবে যাতে তারা স্থানীয় শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেয় এবং নারীদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, ভিয়েতনাম বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য স্কিল ডেভেলপমেন্ট বাধ্যতামূলক করেছে, যার ফলে তাদের শ্রমবাজারে দক্ষতার মান বেড়েছে। বাংলাদেশেও একই ধরনের নীতি গ্রহণ করা জরুরি।
Zero Neglect বা শূন্য অবহেলা নীতির মূল কথা হলো সামাজিক দায়বদ্ধতা উপেক্ষা না করা। অর্থনৈতিক উন্নয়ন শুধু অবকাঠামো নয়, মানবসম্পদ উন্নয়নেও বিনিয়োগ দাবি করে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষি খাতে অবহেলা করলে দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে না। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের টাটা গ্রুপ তাদের CSR (কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা) ফান্ডের বড় অংশ স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় ব্যয় করে, যা স্থানীয় উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশেও এ ধরনের মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। পাশাপাশি, স্থানীয় কোম্পানিগুলোকেও সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হবে।
অন্যদিকে, বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতিতে ESG (Environmental, Social, Governance) মানদণ্ড এখন বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান শর্ত। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে শুধু পণ্য উৎপাদন নয়, বরং পরিবেশবান্ধব ও সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ উৎপাদন নিশ্চিত করা জরুরি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যেই কার্বন বর্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকানিজম (CBAM) চালু করেছে, যার ফলে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন না করলে রপ্তানি খাত বড় ধাক্কা খাবে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প ইউরোপীয় বাজারে ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। যদি কার্বন নির্গমন কমানোর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে রপ্তানি খরচ বাড়বে এবং প্রতিযোগিতা কমে যাবে। উপরুক্ত এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের করণীয় স্পষ্ট। প্রথমত, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে কর ছাড় ও প্রণোদনা দিতে হবে, যাতে শিল্প খাত নবায়নযোগ্য শক্তি ও সবুজ প্রযুক্তি গ্রহণে উৎসাহিত হয়। দ্বিতীয়ত, সামাজিক অন্তর্ভুক্তির জন্য নীতি প্রণয়ন জরুরি, যাতে নারী, প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসন নিশ্চিত করা অপরিহার্য, কারণ বিনিয়োগকারীরা সবসময় স্থিতিশীল নীতি ও স্বচ্ছ প্রশাসনিক কাঠামোকে অগ্রাধিকার দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া ইতিমধ্যেই ESG মানদণ্ডে গুরুত্ব দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সফল হয়েছে। বাংলাদেশও যদি দ্রুত এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করে, তবে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে পারবে।
যদি এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভয়াবহ সংকটে পড়তে পারে। প্রথমত, বৈদেশিক বিনিয়োগ আরও কমে যাবে। ইতিমধ্যেই বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও দুর্বল অবকাঠামোর কারণে দ্বিধাগ্রস্ত; ESG মানদণ্ড পূরণ না করলে ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগ আরও হ্রাস পাবে। দ্বিতীয়ত, জলবায়ু দুর্যোগ কৃষি ও শিল্প খাতকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের ঘূর্ণিঝড় মোখা দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি করেছে, যার প্রভাব খাদ্য নিরাপত্তায় পড়েছে। তৃতীয়ত, সামাজিক বৈষম্য আরও বাড়বে, যা রাজনৈতিক অস্থিরতা ডেকে আনতে পারে। আয়ের বৈষম্য ইতিমধ্যেই উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে; যদি কর্মসংস্থান ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা না করা হয়, তবে সামাজিক অসন্তোষ ও অপরাধ প্রবণতা বাড়বে। সবশেষে, রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতা হারাবে বাংলাদেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কার্বন বর্ডার ট্যাক্স কার্যকর হওয়ার পর পরিবেশবান্ধব উৎপাদন না করলে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি খরচ বাড়বে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থানকে দুর্বল করবে।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বৈশ্বিক অস্থিরতা, জলবায়ু পরিবর্তন, বিনিয়োগ সংকট এবং সামাজিক বৈষম্যের মতো চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরেছে। শুধু প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন এমন একটি উন্নয়ন মডেল যা ন্যায়ভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং পরিবেশবান্ধব। এই প্রেক্ষাপটে Triple Accountability Theory for Planetary Justice (TAP-J) বা ত্রৈমাসিক দায়বদ্ধতা তত্ত্ব হতে পারে একটি কার্যকর দিকনির্দেশনা। শূন্য ক্ষতি (Zero Harm), শূন্য বঞ্চনা (Zero Exclusion) এবং শূন্য অবহেলা (Zero Neglect)—এই তিনটি নীতি বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশ শুধু অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবে না, বরং সামাজিক ন্যায়বিচার ও পরিবেশ সুরক্ষার ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব দিতে পারবে।
এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়—আমরা কি স্বল্পমেয়াদি লাভের পেছনে ছুটব, নাকি দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়নের পথে হাঁটব? ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ, ন্যায়সঙ্গত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে আজই পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: ড. মোহাম্মদ রাশেদ হাসান পলাশ, সহকারী অধ্যাপক, স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআরআই), এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটি অব্ টেকনোলজি অ্যান্ড ইনোভেশন (এপিইউ), কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া। ইমেইল: [email protected]
মন্তব্য করুন