শুক্রবার
৩১ অক্টোবর ২০২৫, ১৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শুক্রবার
৩১ অক্টোবর ২০২৫, ১৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জুলাই গণঅভ্যুত্থান: তরুণদের আত্মত্যাগ থেকে নবযাত্রার বাংলাদেশ

প্রফেসর ড. মোঃ রেজাউল করিম
প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ০১:১০ পিএম
expand
জুলাই গণঅভ্যুত্থান: তরুণদের আত্মত্যাগ থেকে নবযাত্রার বাংলাদেশ

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদ এবং আহতদের প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের পক্ষ থেকে সম্মান ও গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। ২০২৪ সালের ‘জুলাই মাস’ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

এটি ছিল দীর্ঘদিন ধরে চাপা পড়ে থাকা জনঅসন্তোষ, বঞ্চনা, সামাজিক বৈষম্য ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একটি ঐতিহাসিক প্রতিবাদ। যে প্রতিবাদের নেতৃত্ব দেয় মূলত দেশের শিক্ষিত তরুণ সমাজ, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

এই অভ্যুত্থান শুধু একটি নির্দিষ্ট দাবি আদায়ের আন্দোলন ছিল না; বরং এটি ছিল দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর গভীর অসঙ্গতির বিরুদ্ধে এক সুসংগঠিত সামাজিক প্রতিরোধের নাম।

এই প্রতিরোধ-আন্দোলন, যা ইতিহাসে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ বা ‘জুলাই বিপ্লব’ নামে খ্যাত, তা শুধুমাত্র সরকারের পরিবর্তন নয়, বরং একটি ন্যায্য, মানবিক ও জবাবদিহিতার রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় থেকে উৎসারিত।

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সমাজ-অর্থনীতি ও রাজনীতির বিভিন্ন স্তরে একটি অসমতা ও বৈষম্যের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। সরকারি চাকরিতে বৈষম্যপূর্ণ কোটাব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় সম্পদের পক্ষপাতমূলক বণ্টন, প্রশাসনে দলীয়করণ, গণতান্ত্রিক চর্চার সংকোচন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা- সবকিছু মিলিয়ে দেশে এক অস্থির সামাজিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিছল। এসব অসঙ্গতির বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকেই ক্ষোভ জমছিল সাধারণ মানুষের মনে, বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে।

এই জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে ২০২৪ সালের জুন মাসে, যখন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ সরকারি চাকরিতে কোটা সংক্রান্ত এক পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে। সেই রায়ের পর শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে সংগঠিত হয়ে সারাদেশে বিক্ষোভ শুরু করে। তারা তখন কেবল একটি রায় বাস্তবায়নের দাবি করেনি; বরং রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বত্র ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষাকে সামনে এনেছিল। শিক্ষার্থীরা বুঝেছিল, কোটার সংস্কার কেবল একটি প্রতীক- আসলে এটি বৃহত্তর এক রাষ্ট্রীয় রূপান্তরের সূচনা।

আন্দোলনের অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল এর বিকেন্দ্রীভবন ও বিকল্প নেতৃত্বের মডেল। শুরু থেকেই আন্দোলনের নির্দিষ্ট কোনো মুখপাত্র ছিল না। বরং সারাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মনোনীত ৬৫ সদস্যের সমন্বয় কমিটি আন্দোলনকে পরিচালনা করে, যার মধ্যে ২৩ জন ছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক। এটি ছিল এক অভুতপূর্ব সাংগঠনিক রূপ।

১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদ এবং ১৮ জুলাই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ডিসিপ্লিনের ’১৯ ব্যাচের মেধাবী ছাত্র মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ-এর আত্মত্যাগ আন্দোলনকে নতুন উ”চতায় নিয়ে যায়। তাদের সাহসিকতা এবং জীবনদান গোটা জাতিকে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে টেনে আনে। সেদিন থেকে আন্দোলন আর কেবল শিক্ষার্থীদের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ থাকেনি- এটি হয়ে উঠেছিল একটি সর্বজনীন জাতীয় অভ্যুত্থান। সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী শ্রেণি, চাকরিপ্রার্থী যুবক-যুবতী এবং সমাজের নানা স্তরের নাগরিকেরা এতে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন।

এই পর্যায়ে আন্দোলনের ভাষা ও কৌশল আরও সুসংগঠিত হয়। প্রতিবাদের পাশাপাশি উপ¯’াপন করা হয় বিকল্প চিন্তাধারা- একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র কাঠামোর প্রস্তাবনা। ১ আগস্ট দেশজুড়ে জনতার এক অপূর্ব সংহতি দেখা যায়। এর ফলে সরকারের ভিত কেঁপে ওঠে। প্রতিরোধের মুখে তৎকালীন সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয় এবং ৫ আগস্ট তার পতন ঘটে। আন্দোলনকারীরা এই দিনটিকে আখ্যা দেন ‘৩৬ জুলাই’ নামে, যা কেবল প্রতীকী নয়, বরং দার্শনিক এক অবস্থান সময়কে নিজেদের মতো করে সংজ্ঞায়িত করে তারা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে।

এই রাজনৈতিক পালাবদলের পর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়, যার অগ্রাধিকারে ছিল- গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার, প্রশাসনিক সংস্কার এবং তরুণ সমাজের স্বপ্ন পূরণের নীতিনির্ধারণ।

২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে আন্তর্জাতিক মহলে আরব বসন্তের আলোকে ‘বাংলা বসন্ত’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রশংসা করেছে। দেশের ভাবমূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নতুন গতিপথে প্রবেশ করেছে।

আন্দোলনের সময় এবং পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবৃতি, সমর্থন ও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বিবিসি, আল জাজিরা, নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ানসহ প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলো একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানায়। অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন একাত্মতা জানিয়ে কর্মসূচি পালন করে, যা প্রমাণ করে- এটি কেবল একটি জাতীয় নয়, বৈশ্বিক মনোযোগ আকর্ষণকারী অভ্যুত্থান।

এই আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল প্রযুক্তির নবীন ব্যবহার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে সংগঠিত হওয়া, বার্তা প্রচার, তথ্য যাচাই ও সহিংসতা ডকুমেন্ট করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের ভাষাকে আধুনিক ও গতিশীল রূপ দিয়েছিল। তারা দেখিয়েছে- নেতৃত্ব শুধু রাজনৈতিক দলে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সচেতন নাগরিকরাই ভবিষ্যতের দিকনির্দেশক।

এই অভ্যুত্থানে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ছাত্রীরা যেমন নেতৃত্ব দিয়েছে, তেমনি নারীকর্মী, শিক্ষক, লেখকসহ সর্বস্তরের নারীরা তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তাদের সক্রিয় ভ‚মিকা, প্রতিরোধে অংশগ্রহণ, সমাবেশে নেতৃত্ব, সামাজিক মাধ্যমে উপস্থিতি- সব মিলিয়ে এটি হয়ে উঠেছিল বহুমাত্রিক গণআন্দোলন। নারীর অধিকার ও সমতা নিয়েও আলোচনার জন্ম দেয় এই আন্দোলন, যা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার জন্ম দিয়েছে। শুধু রাজনীতি নয়, শিল্প, সাহিত্য, নাটক, চল চিত্র ও সংগীতেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে কবিতা, পোস্টার আর গ্রাফিতির মাধ্যমে নতুন এক ভাষা রচিত হয়েছে। অনেক তরুণ লেখক ও গবেষক এই অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে গবেষণাকর্ম, প্রতিবেদন ও স্মৃতিকথা প্রকাশ করছেন। এটি প্রমাণ করে; এই আন্দোলন শুধুই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি এক সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ।

এদিকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যেই ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করেছে, যেখানে আন্দোলনের সময় উ”চারিত মৌলিক লক্ষ্য ও জাতীয় অঙ্গীকারগুলোকে প্রাথমিকভাবে স্থান দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার বিষয়টিও অপেক্ষায় রয়েছে। এই সনদ কার্যকরের মধ্য দিয়েই জুলাই-২৪-এর আত্মত্যাগকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ¯’স্থায়ী রূপ দেওয়ার প্রত্যাশা করা হয়েছ।

অনেকের মতে, এই সনদ হবে নতুন বাংলাদেশের জন্য একটি দিকনির্দেশনামূলক দলিল, যেখানে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, সমতা ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের রূপরেখা সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হবে।

জুলাই আন্দোলনের অদম্য ঐক্য ও স্পিরিট বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে অটুট রাখতে হবে। যে কোনো ধরনের ব্যক্তি স্বার্থ, রাজনৈতিক বিভাজন ও বিভক্তিকে রুখে দিতে হবে। আন্দোলনের সময়কার সংহতি ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে যে অভ্যুত্থান কোটি মানুষের মাঝে আশার আলো জ্বালিয়েছিল, সেই অভ্যুত্থানকে ঝুঁকিতে ফেলা যাবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে- স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আন্দোলনের চেতনা শুধু স্মৃতিতে নয়, কর্মে, নীতি-নির্ধারণে ও বাস্তবায়নে ধরে রাখতে হয়।

তবে এই নবযাত্রার পথ সহজ নয়। এখনও সমাজের বিভিন্ন খাতে পুরনো ধাঁচের প্রভাব, অব্যবস্থাপনা ও নীতিগত দ্বিধা রয়ে গেছে। আইনি সংস্কার, প্রশাসনিক জবাবদিহিতা, শিক্ষার আধুনিকায়ন, তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রয়োজন আরও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। তরুণদের অংশগ্রহণ কেবল আন্দোলনে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না; নীতিনির্ধারণ, গবেষণা এবং নেতৃত্বেও তাদের উপস্থিতি অপরিহার্য। সুশাসনের ভিত রচনায় শিক্ষক, প্রশাসক, জনপ্রতিনিধি, মিডিয়া ও নাগরিক সমাজকে ঐক্যবদ্ধভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

২০২৪ সালের জুলাই মাস কেবল একটি অভ্যুত্থানের প্রতীক নয়, এটি ছিল এক নবজাগরণের সূচনা। এটি আমাদের শিখিয়েছে- যদি জনতা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং তরুণরা স্বপ্ন দেখতে শেখে, তবে পরিবর্তন সম্ভব। জুলাই-২৪ কেবল একটি আন্দোলনের ফসল নয়, বরং একটি সভ্যতা গঠনের সূচনা। এই সূচনালগ্নে জাতীয় ঐক্যই পারে নবযাত্রার বাংলাদেশকে টেকসই ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নিতে।

লেখক : উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন