শুক্রবার
৩১ অক্টোবর ২০২৫, ১৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শুক্রবার
৩১ অক্টোবর ২০২৫, ১৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশ পুলিশের ওপর হামলা: আইনের শাসনের প্রতি এক মারাত্মক চ্যালেঞ্জ

সাধন চন্দ্র বসাক, লেখক ও গবেষক
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:১০ পিএম
বাংলাদেশ পুলিশের ওপর হামলা
expand
বাংলাদেশ পুলিশের ওপর হামলা

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিশেষ করে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই হামলাগুলো কেবল কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং তা দেশের আইনের শাসন, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের ওপর সরাসরি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো প্রায়শই উচ্ছৃঙ্খল জনতা দ্বারা বহুবিধ কারণে, আসামি ছিনিয়ে নেওয়া বা রাজনৈতিক সংঘাতের ফলে ঘটছে, যা আইনশৃঙ্খলার ভিত্তিকেই নাড়িয়ে দিচ্ছে। পুলিশের মনোবল ভেঙে দেওয়া এবং আইন প্রয়োগে দ্বিধা তৈরি করাই এর মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সংকট দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগ এবং জনগণের নিরাপত্তাকে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। এই প্রবণতা বন্ধ না হলে সন্দেহাতীতভাবে অচিরেই দেশ এক গভীর নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত হবে। মনে রাখা দরকার, পুলিশ কেবল একটি বাহিনী নয়, বরং তারা রাষ্ট্রের আইনের শাসনের প্রথম সারির যোদ্ধা।

পুলিশের ওপর হামলার ঘটনাগুলো সাধারণত বিচ্ছিন্ন নয়, বরং এর পেছনে বহুস্তরীয় সামাজিক, রাজনৈতিক ও কাঠামোগত কারণ রয়েছে। সাম্প্রতিককালে পুলিশের ওপর বেশিরভাগ হামলার ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, একটি উচ্ছৃঙ্খল জনতা সংঘবদ্ধভাবে পুলিশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশকে মারধর, তাদের অস্ত্র কেড়ে নেওয়াসহ আসামি ছিনিয়ে নিচ্ছে। তাছাড়া পুরনো সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক আন্দোলন বা সমাবেশের সংঘাতের সময় পুলিশই প্রথম ও প্রত্যক্ষ লক্ষ্যবস্তু হওয়ার প্রবণতা রয়েছেই। দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের কিছু কর্মকর্তার অপেশাদার আচরণ, ক্ষমতার অপব্যবহার, হয়রানির অভিযোগ জনগণের মধ্যে পুলিশের প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক ধারণাও এর জন্য দায়ী। অনেক ক্ষেত্রে যথাযথভাবে পুলিশের আইন প্রয়োগ ও সরঞ্জামের ঘাটতির ফলে তারা অপ্রত্যাশিত বা সংঘবদ্ধ আক্রমণকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে পারছে না।

চাঁদাবাজদের হাতেনাতে ধরতে এই অক্টোবর মাসের ৪ তারিখে অভিযানে নেমেছিলেন নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন। এ সময় চাঁদাবাজদের হামলায় তাঁর বুকের একটি হাড় ভেঙে যায়। একই দিনে বগুড়ার শিবগঞ্জে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে উচ্ছৃঙ্খল জনতা হাতকড়াসহ ১২ মামলার আসামি এক আওয়ামী লীগ নেতাকে ছিনিয়ে নেয়। ৯ অক্টোবর চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় অনুমোদনবিহীন ব্যাটারিচালিত টমটম গাড়ির চালক পুলিশের সংকেত অমান্য করে বেপরোয়া গতিতে চালিয়ে যাওয়ার সময় সার্জেন্ট প্রিয়তোষ বড়ুয়া গাড়িটি আটক করেন। এ সময় টমটমের চালক ৮–১০ জন সহযোগী নিয়ে মব সৃষ্টি করে ওই সার্জেন্টকে মারধর করে আহত করে। এভাবে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও পুলিশের ওপর এমনকি থানাসহ পুলিশের স্থাপনার ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশের আটটি বিভাগেই পুলিশের ওপর হামলা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। এই আট মাসে সারা দেশে ৪১৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১৬৪টি মামলা হয়েছে। এরপর চট্টগ্রামে ৯২টি, সিলেটে ৪৩টি, রাজশাহীতে ৩৫টি, খুলনা ও বরিশালে ৩০ ও ২৬টি, ময়মনসিংহে ১৩টি এবং রংপুরে সবচেয়ে কম ১২টি হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় দৈনিক গড়ে আটটি মামলা হয়। অর্থাৎ আটটি হামলার ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সারা দেশে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ছিল ৩১টি, তবে গত আগস্টে তা বেড়ে ৫১টি হয়েছে। প্রতি মাসেই এই হামলা বাড়ছে (তথ্যসূত্র: আজকের পত্রিকা, ৬ অক্টোবর ২০২৫)। চলতি অক্টোবর মাসের ১০ তারিখের মধ্যেই দেশে অন্তত ৮টি পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।

গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকেই পুলিশের ওপর হামলার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। জুলাই অভ্যুত্থানে সারা দেশে পুলিশের ৪৬০টি অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ১২০টি থানা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিহত হন ৪৬ জন পুলিশ সদস্য। এর ফলে তাদের মনোবল হামলার ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। তার মধ্যেই এখনো হামলা চলছে। পুলিশের বৈধ দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদান, হামলা বা লাঞ্ছনার ঘটনা নিঃসন্দেহে সংবিধান, জাতীয় নিরাপত্তা ও গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে বড় হুমকির পাশাপাশি অত্যন্ত উদ্বেগজনক, নিন্দনীয় ও দুঃখজনক ঘটনা।

পুলিশের ওপর হামলা বৃদ্ধি পাওয়ায় তা কেবল আইনশৃঙ্খলার ওপর নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। পুলিশ রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এর ওপর আক্রমণ মানে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বকেও চ্যালেঞ্জ করা। হামলার মাধ্যমে আসামি ছিনতাই হলে বিচার প্রক্রিয়া দুর্বল হবে এবং অপরাধীরা, বিশেষ করে বড় বড় মাদক ব্যবসায়ী ও চাঁদাবাজরা, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি থেকে পার পেয়ে যাবে। পুলিশ জীবন ও নিরাপত্তার ভয়ে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে না পারায় অপরাধীরা দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে, ফলে চুরি, ডাকাতি, মাদক ও চাঁদাবাজির মতো সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুলিশ সদস্যরা যেখানে নিজেদেরই সুরক্ষা দিতে পারছে না, সেখানে জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করা তাদের জন্য কঠিনই বটে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে পুলিশকে ঠিকভাবে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড় করাতে না পারলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্নে ঝুঁকি থেকে যাবে।

এ হামলাগুলোর ফলে আন্তর্জাতিক মহলে দেশের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নিরাপত্তার অভাবে বিনিয়োগ করতে দ্বিধা করছেন। বিদেশি পর্যটকের অভাবে এ শিল্পে ব্যাপকভাবে স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে। এক কথায় বলা যেতে পারে, দেশের সার্বিক উন্নয়নই ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আইন ও বিচার সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি এবং আইন যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন অপরাধী বেপরোয়া হয়ে ওঠে।’

ইতিমধ্যে পুলিশের ওপর ক্রমাগত হামলা ও আক্রমণের বিষয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘পুলিশের ওপর এ রকম হামলা ঠেকাতে সবার কথা বলতে হবে। পুলিশ যদি কাজ না করতে পারে, তাহলে কেউ নিরাপদ থাকবেন না।’

বাংলাদেশ পুলিশের ওপর হামলা রোধ করা কেবল একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নয়, বরং সমগ্র রাষ্ট্রের জন্য একটি অপরিহার্য প্রয়োজন। পুলিশের ওপর হামলা এবং সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি রোধ করতে হলে সমস্যাগুলোর মূল কারণ চিহ্নিত করে বহুমুখী ও সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এসব ঘটনার দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।

তাছাড়া দেশ ও দশের স্বার্থেই উচ্ছৃঙ্খল জনতার হামলা মোকাবিলার জন্য পুলিশ সদস্যদের বিশেষ প্রশিক্ষণ ও আধুনিক সরঞ্জাম সরবরাহ করা, পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে তাদের পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করা, পুলিশের মধ্যে থাকা কিছু কর্মকর্তার অপেশাদার আচরণ, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। পুলিশকে জনগণের বন্ধু ও সেবক হিসেবে কাজ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের কাছে সময়ের দাবি, পুলিশ সংস্কারের জন্য একটি স্বতন্ত্র কমিশন গঠন করে পুলিশকে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

পুলিশের ওপর হামলা বৃদ্ধি প্রমাণ করে যে, দেশের আইনের শাসন এক কঠিন পরীক্ষার মুখে। এর ফলে পুলিশ সদস্যদের মনোবল নষ্ট হচ্ছে এবং অপরাধ দমনে তাদের কার্যকারিতা কমছে, যা প্রকারান্তরে সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তাকেই হুমকির মুখে ফেলছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, পুলিশের অভ্যন্তরীণ সংস্কার এবং জনগণের সঙ্গে আস্থার বন্ধন তৈরি করা অপরিহার্য। যতক্ষণ পর্যন্ত না পুলিশকে জনগণের বন্ধু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে এবং হামলাকারীরা কঠোর শাস্তির আওতায় আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্থিতিশীলতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা কঠিন হবে। তাই দেশের আইনের শাসন এবং সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থেই পুলিশকে জনগণের বন্ধু হিসেবে গড়ে তোলা এবং তাদের ওপর হামলার সংস্কৃতি বন্ধ করা প্রয়োজন। আর এ দায়িত্ব রাষ্ট্র, বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী ও জনগণের দ্রুত নেওয়া উচিত।

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন