বৃহস্পতিবার
৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১৪ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বৃহস্পতিবার
৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১৪ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আমতলী স্বাস্থ্যসেবা: ৩১ চিকিৎসকের স্থলে কাজ করছেন মাত্র ৪ জন

আমতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৩৯ পিএম
ফাইল ছবি
expand
ফাইল ছবি

উপকূলীয় জনপদ বরগুনার আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এখন চরম জনবল সংকটে ধুঁকছে। প্রায় তিন লাখ মানুষের একমাত্র সরকারি ভরসাস্থল এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বেহাল দশা স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবার করুণ চিত্র তুলে ধরেছে।

৫০ শয্যার এই হাসপাতালে ৩১ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ৪ জন। এর ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করতে হচ্ছে এলাকার দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে।

দৈনিক শত শত রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন হাতে গোনা কয়েকজন চিকিৎসক। পর্যাপ্ত সেবা না পেয়ে প্রতিদিনই অসংখ্য রোগী ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকেই আবার চিকিৎসার জন্য পটুয়াখালী, বরিশাল বা ঢাকার মতো বড় শহরে ছুটে যাচ্ছেন—যা উপকূলীয় দরিদ্র মানুষের জন্য বাড়তি আর্থিক চাপ তৈরি করছে।

চিকিৎসা নিতে আসা স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কালাম বেদনার সঙ্গে বলেন, “গত বছর মেয়ে অসুস্থ হলে কিস্তি করে বরিশাল নিয়ে চিকিৎসা করাতে হয়েছে। গরিব মানুষরে চিকিৎসা নাই, আমরা নাপা খাইয়া ঘরে বইসা থাকি।”

ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোও কার্যত অচল

শুধু উপজেলা সদরের হাসপাতাল নয়, ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর অবস্থাও করুণ। কুকুয়া ইউনিয়নের আজিমপুর বাজারে ১০ শয্যার হাসপাতাল, আঠারগাছিয়া ইউনিয়নের গাজীপুর বাজার ও গুলিশাখালী ইউনিয়নের উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র, এছাড়া হলদিয়া ইউনিয়নের সেনের হাটে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র—সবখানেই চিকিৎসক সংকটে কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।

চিকিৎসক সংকটের পাশাপাশি কর্মচারী সংকটও ভয়াবহ। সামগ্রিকভাবে হাসপাতালের প্রশাসনিক কার্যক্রম, পরিচ্ছন্নতা ও জরুরি সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

মানবিক মর্যাদা ও নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসক সংকটের পাশাপাশি কর্মচারী সংকটও তীব্র আকার ধারণ করেছে। হাসপাতালের ৮৮টি তৃতীয় শ্রেণির পদের মধ্যে ৫২টি এবং ৩৪টি চতুর্থ শ্রেণির পদের মধ্যে ১৬টি পদ শূন্য রয়েছে।

রোগীরা অভিযোগ করেছেন, নিয়মিত চিকিৎসা সেবা তো পাচ্ছেনই না, বরং কিছু নার্সের অসৌজন্যমূলক আচরণ তাদের ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। জনবল না থাকায় অপারেশন থিয়েটারসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন ধরে অচল অবস্থায় পড়ে আছে। প্রতিদিন শতাধিক রোগী যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন বা অন্য জেলায় রেফার হচ্ছেন। এটি কেবল প্রশাসনিক নয়, একটি মানবিক সংকট।

স্থানীয়রা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে আমতলীর সাধারণ মানুষ পুরোপুরি উন্নত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হবেন। উপকূলের মানুষের জীবন রক্ষায় জনবল সংকট নিরসনে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন সুশীল সমাজ ও ভুক্তভোগীরা।

মানবাধিকার কর্মী জোসেফ মাহতাব এ পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি এটিকে “কেবল প্রশাসনিক সমস্যা নয়, একটি মানবিক সংকট” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “সরকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে আন্তরিক। তবে আমতলীসহ উপকূলীয় এলাকায় দ্রুত চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিলে মানুষের আস্থা আরও বাড়বে। বিশেষ করে এই অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দারিদ্র্য এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক বেশি। এখানে চিকিৎসাসেবা শক্তিশালী করা মানে শুধু হাসপাতাল সচল রাখা নয়, এটি মানুষের মানবিক মর্যাদা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়।”

আমতলী সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি জসিম উদ্দিন সিকদার দ্রুত পদক্ষেপের দাবি জানিয়ে বলেন, “উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকটের কারণে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াইশ রোগী ভোগান্তিতে পড়ছেন। তারা যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছেন না। দ্রুত চিকিৎসক ও জনবল নিয়োগের দাবি জানাচ্ছি।”

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. চিন্ময় হাওলাদার বলেন, “চিকিৎসক সংকটের কারণে জরুরি বিভাগসহ সব কার্যক্রম সামলাতে প্রচণ্ড বেগ পেতে হচ্ছে। আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক চেয়েছি।”

বরগুনার সিভিল সার্জন ডা. মো. আবুল ফাত্তাহ বলেন, “বিষয়টি আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে জানিয়েছি এবং দ্রুত চিকিৎসক নিয়োগের জন্য অনুরোধ করেছি।”

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন