

জলবায়ু ন্যায়বিচার নিশ্চিতে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের উন্নয়ন দর্শনে পরিবর্তন এনে প্রশমনে প্রাধান্য দেওয়া এবং ভোগের ধরনে পরিবর্তন আনার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
রাজনৈতিকভাবে সরকারকে আরও সাহসী ভূমিকা পালন করতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, জলবায়ু অর্থায়নে বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। উন্নত দেশগুলো যদি নিজেদের জলবায়ু রোধে অবদান বাড়াতে না পারে, তাহলে আমাদের মতো জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর বাঁচার পথ রুদ্ধ হবে। জলবায়ু ন্যায্যতার প্রশ্নে বাংলাদেশকে আরও জোরালো ভূমিকা নিতে হবে।
মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত পরিবেশ অধিদপ্তর মিলনায়তনে আয়োজিত ‘জনগণের নেতৃত্বে নীতি প্রণয়ন: কপ৩০-এ বাংলাদেশের অবস্থান’ প্রকাশ শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশের ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরকে বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসতে আসন্ন কপ৩০-এর জন্য বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ সংস্থাগুলোর (সিএসও) সম্মিলিত অবস্থানপত্র আজ ঢাকায় প্রকাশ করা হয়েছে। এই অবস্থানপত্রটি ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠাতব্য জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক বৈশ্বিক সম্মেলন কনফারেন্স অব পার্টিজ ৩০ (কপ ৩০) -এর টেবিলে বাংলাদেশের জনগণের মূল দাবি সমূহ ও কৌশলগত অগ্রাধিকারগুলো তুলে ধরবে।
নাগরিক সমাজ সংস্থাগুলোর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে জলবায়ু কূটনীতিতে একটি সমন্বিত অবস্থানের গুরুত্ব তুলে ধরেন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
উপদেষ্টা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি কেবল টাকায় পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। অর্থ দিয়ে নদীভাঙন, জীববৈচিত্র্য হ্রাস কিংবা মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা যায় না। পাশাপাশি, উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশ ও জলবায়ু ঝুঁকিকে কেন্দ্রীয়ভাবে বিবেচনায় নেওয়ার ওপর জোর দেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, আমরা যদি এখনই আমাদের উন্নয়ন দর্শন ও সিদ্ধান্তে জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে না পারি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তখন আর মানবিক বা টেকসই থাকবে না।
দেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ৩৫টি সংস্থার উদ্যোগে বাংলাদেশের প্রান্তিক পর্যায়ে ধারাবাহিক সংলাপ থেকে তৈরি এই অবস্থানপত্রে জলবায়ু ন্যায্যতাকে মূলনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অবস্থানপত্র প্রকাশ অনুষ্ঠানে আসন্ন বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের জনগণের দাবি ও কৌশলগত অগ্রাধিকার সমূহ কীভাবে তুলে ধরা যায় সেই বিষয়ে মুক্ত আলোচনার আয়োজন করা হয়। এতে জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্তদের সরাসরি অর্থায়ন ও অ-অর্থনৈতিক ক্ষতির স্বীকৃতি; বৈশ্বিক অভিযোজন লক্ষ্যমাত্রা এবং প্যারিস চুক্তির অনুচ্ছেদ ৬’এর কৌশলগত ব্যবহার নিয়ে আলোচনা হয়। ধনী দেশগুলোকে তাদের নির্গমন হ্রাসের অঙ্গীকার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানোর পাশাপাশি, জ্বালানি রূপান্তরে ন্যায্যতা নিশ্চিত এবং জলবায়ু সিদ্ধান্তে জেন্ডার সমতা ও যুব নেতৃত্বকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখার দাবি জানানো হয়েছে অনুষ্ঠানে।
এছাড়াও, বৈশ্বিক জলবায়ু ন্যায্য রূপান্তরের দাবিতে, বিশ্বজুড়ে নাগরিক সমাজ জাতিসংঘের জলবায়ু কাঠামোর মধ্যে ‘বেলেম অ্যাকশন মেকানিজম ফর এ গ্লোবাল জাস্ট ট্রানজিশন (বাম)’ অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে আহ্বান জানাচ্ছে।
এসময় বক্তারা বলেন, কপ৩০-এ বাংলাদেশের সবচেয়ে জরুরি চাওয়া হলো লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিলের দ্রুত কার্যকরকরণ। এই তহবিলকে অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও শিশুসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সরাসরি ও সহজলভ্য করতে হবে, যাতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অর্থ আটকে না যায়। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সম্পদ-ঐতিহ্য এবং স্বাস্থ্যের মতো অ-অর্থনৈতিক ক্ষতির স্বীকৃতি ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। এই অবস্থানপত্রটি শুধু নীতি প্রণয়নের জন্য নয়, এটি দেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর কণ্ঠ যেন বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় প্রতিফলিত হয় তা নিশ্চিত করবে বলে মনে করেন একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির। তিনি তাঁর উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয় প্রান্তিক এলাকার নারী ও শিশুরা। তাই জলবায়ু নীতিতে জেন্ডার সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নকে কেন্দ্রীয় অবস্থানে আনা অত্যাবশ্যক। আমাদের এই অবস্থানপত্রটি নিশ্চিত করে যে- জলবায়ু সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জেন্ডার সমতা, যুব নেতৃত্ব ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (ন্যাকম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. এস এম মুনজুরুল হান্নান খান প্যারিস চুক্তির অনুচ্ছেদ ৬ নিয়ে বলেন, আমরা অনুচ্ছেদ ৬-কে অর্থায়ন, প্রযুক্তি এবং সক্ষমতা তৈরির সহায়তা নিশ্চিত করার একটি কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। কার্বন বাজারের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে জলবায়ু অর্থায়ন আকর্ষণ এবং জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে নিজেদের নেতৃত্বের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করাই আমাদের লক্ষ্য।” অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ড. মু. সোহরাব আলী। এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন অধিদপ্তরের পরিচালক শওকত আলী মির্জা। তাঁরা আয়োজকদের এই গবেষণামূলক উদ্যোগকে সরকারের সঙ্গে নীতি সমন্বয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখেন।
অনুষ্ঠানে জলবায়ু বিষয়ক বিভিন্ন উপস্থাপনা প্রদান করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ইনভাইরনমেন্টাল রিসার্চ (সিথ্রিইআর))-এর সহকারী পরিচালক রউফা খানম; একশনএইড বাংলাদেশ-এর জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশন ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ, চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ-এর রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট এম. মোফাজ্জাল হোসেন; কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড-এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার আফসারী বেগম এবং অ্যাসোসিয়েট ট্রেইনার সাদিয়া আক্তার। এছাড়াও অনুষ্ঠানে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি, তরুণ জলবায়ুকর্মী, গবেষক ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞসহ গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
মন্তব্য করুন