

বিমানবন্দর মানেই শুধু যাত্রী ওঠানামার কেন্দ্র নয়, এর আড়ালে চলে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম, আর তা হলো কার্গো পরিবহন। এই কার্যক্রমের মূল কেন্দ্র হচ্ছে কার্গো ভিলেজ।
কার্গো ভিলেজ হচ্ছে এমন একটি বিশেষায়িত এলাকা, যেখানে পণ্য গ্রহণ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং প্রেরণের সব কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ পণ্য এই ভিলেজ দিয়ে দেশের বাইরে যায় এবং আসে।
চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধ, ইলেকট্রনিকস, পোশাক, কৃষিপণ্যসহ নানা রকমের দ্রব্য এখানে সংরক্ষণ ও সরবরাহের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়।
কার্গো ভিলেজের কার্যক্রম বিভিন্ন বিভাগে বিভক্ত এবং প্রতিটি বিভাগে বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। স্টোরেজ ও ওয়্যারহাউজে পণ্যগুলো অস্থায়ীভাবে রাখা হয়, যেখানে তাজা ও ভঙ্গুর পণ্য আলাদা করে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয় যাতে গুণগত মান বজায় থাকে। কাস্টমস ও প্রক্রিয়াজাতকরণের এলাকা পণ্যের কাগজপত্র যাচাই, শুল্ক হিসাব এবং এক্স-রে স্ক্যানারের মাধ্যমে নিরাপত্তা চেকের দায়িত্বে নিয়োজিত। লোডিং ও আনলোডিং জোনে হ্যান্ডলিং মেশিন, ফর্কলিফ্ট এবং কনভেয়ার বেল্ট ব্যবহার করে দ্রুত ও কার্যকরভাবে বিমানে পণ্য তোলা-নেওয়ার কাজ সম্পন্ন করা হয়। অফিস ও প্রশাসনিক ভবনে কার্গো অপারেটর, শিপিং কোম্পানি এবং বিমান কর্তৃপক্ষের অফিস রয়েছে যারা পুরো কার্যক্রমের সমন্বয় করে থাকেন। নিরাপত্তার জন্য কার্গো ভিলেজে ২৪ ঘণ্টা সিসিটিভি নজরদারি, সীমিত প্রবেশাধিকার এবং আগুনের সময় ব্যবহারের জন্য রিমোট কন্ট্রোল ফায়ারফাইটিং রোবট ব্যবহার করা হয়। এছাড়া এখানে কনটেইনার ডিপো, বিপজ্জনক পণ্য হ্যান্ডলিং, ট্র্যাকিং ও ডকুমেন্টেশন সেন্টারসহ বিশেষ সুবিধাও রয়েছে, যা দেশের বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হিসেবে কার্গো কার্যক্রমের নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করে।
বিমানবন্দরের অন্যতম ব্যস্ততম অংশ হলো কার্গো ভিলেজ, যেখানে প্রতিদিন বিশাল পরিমাণ পণ্য ওঠানামা করে থাকে। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাটি মাঝে মাঝে বিপদের মুখে পড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কার্গো এলাকায় আগুন লাগার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ উদ্বিগ্ন। কার্গো ভিলেজে রয়েছে ওয়্যারহাউজ, কনটেইনার টার্মিনাল, কাস্টমস চেকপয়েন্ট, ফ্রিজার রুম এবং প্রশাসনিক অফিস, যেখানে তেল, ব্যাটারি, রাসায়নিক দ্রব্য, ইলেকট্রনিক্স থেকে শুরু করে দ্রুত পচনশীল খাবারসহ নানা ধরনের পণ্য সংরক্ষণ করা হয়। এই কারণে আগুন লাগার ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি এবং এটি নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করে।
কার্গো ভিলেজে আগুন লাগার কয়েকটি সাধারণ কারণ রয়েছে। প্রথমত, ফ্ল্যামেবল বা দাহ্য পণ্য থেকে বিস্ফোরণ, যেমন তেল, গ্যাস, ব্যাটারি বা রাসায়নিক দ্রব্য যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করা হয়, তাহলে তা থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ইলেকট্রিক শর্ট সার্কিট, যা গুদামে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বা তারের ত্রুটির কারণে ঘটে। তৃতীয়ত, মানবিক ভুল, যেমন ধূমপান, স্পার্ক তৈরি বা পণ্য সরানোর সময় অমনোযোগও আগুন লাগার বড় কারণ হিসেবে কাজ করে। চতুর্থত, তাপমাত্রার প্রভাব, যেখানে কিছু রাসায়নিক দ্রব্য অতিরিক্ত তাপে নিজে থেকেই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে আগুন লাগার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই সব কারণগুলো মোকাবিলায় কার্গো ভিলেজে বিশেষ সতর্কতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
এরা আগে ২০২০ সালে দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনালে ব্যাটারি সংরক্ষণ এলাকায় ভয়াবহ আগুন লাগে। পরে তদন্তে জানা যায়, ব্যাটারি যথাযথভাবে আলাদা না করে রাখায় শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। ২০১৯ সালে চীনের সাংহাইয়ের কার্গো ওয়্যারহাউজে রাসায়নিক দ্রব্য থেকে সৃষ্ট আগুনে পুড়ে যায় শতাধিক টন পণ্য। দাহ্য পদার্থের পাশে বৈদ্যুতিক সংযোগ থাকাই ছিল প্রধান কারণ। ২০১৬ সালে নিউইয়র্কে ইলেকট্রনিক কার্গো থেকে শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন লাগে। তাৎক্ষণিকভাবে অ্যালার্ম সাড়া দিলেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে কয়েকটি সংরক্ষণ কন্টেইনারে।
এ ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলায় আধুনিক কার্গো ভিলেজগুলোতে নেওয়া হয় বহুমুখী ও উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আগুনের প্রাথমিক ইঙ্গিত শনাক্ত করতে প্রতিটি স্থানে স্থাপন করা হয় অগ্নি শনাক্তকরণ ব্যবস্থা, যা ধোঁয়া বা তাপমাত্রা বেড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে সাউন্ড অ্যালার্ম দিয়ে সতর্ক করে। প্রতিটি ওয়্যারহাউজে থাকে স্বয়ংক্রিয় পানি স্প্রিংকলার এবং ফায়ার হাইড্রান্ট, যা দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। পাশাপাশি ব্যবহৃত হয় রিমোট কন্ট্রোল ফায়ারফাইটিং রোবট, যা সরাসরি মানব হস্তক্ষেপ ছাড়াই আগুন নেভাতে পারে, এটি বিশেষভাবে কার্যকর যেখানে প্রবেশ ঝুঁকিপূর্ণ। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ২৪ ঘণ্টা সিসিটিভি নজরদারিতে থাকে প্রতিটি সংরক্ষিত এলাকা। পাশাপাশি কর্মীদেরও নিয়মিত অগ্নি নিরাপত্তা ও জরুরি প্রতিক্রিয়া প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাতে তারা দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে যেকোনো দুর্ঘটনায় মোকাবিলা করতে পারেন। সব মিলিয়ে, এই আধুনিক ব্যবস্থাগুলোই একটি সুরক্ষিত ও কার্যকর কার্গো ভিলেজ পরিচালনার ভিত্তি তৈরি করে।
কার্গো ভিলেজ একটি দেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করে। প্রতিদিন এখানে বিপুল পরিমাণ পণ্য ওঠানামা করে, যা আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমকে সচল রাখে। তবে এর ভেতরে থাকা পণ্য ও প্রযুক্তির বৈচিত্র্যের কারণে সবসময়ই কিছু না কিছু ঝুঁকি লুকিয়ে থাকে। বিশেষ করে আগুন, বিস্ফোরণ বা নিরাপত্তা হানির মতো বড় বিপদের সম্ভাবনা। আর এই ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা, নিয়মিত পরিদর্শন, এবং প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। শুধু অবকাঠামো নয়, মানুষের দক্ষতা, সময়মতো প্রতিক্রিয়া এবং ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতাও এসব স্থাপনাকে সুরক্ষিত রাখতে বড় ভূমিকা রাখে।
মন্তব্য করুন