

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


আধ্যাত্মিক গুরু ও বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের ১৩৫তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় শুরু হয়েছে জাতীয় লালন স্মরণ উৎসব।
তিন দিনব্যাপী এই আয়োজনে ছেঁউড়িয়ায় জড়ো হয়েছেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা লাখো ভক্ত, সাধু-বাউল ও দর্শনার্থী। ভক্তিভরে মুখরিত হয়ে উঠেছে লালনের আখড়াবাড়ি ও আশপাশের এলাকা।
শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই বর্ণাঢ্য আয়োজন। আলোচনা সভা, লালনের গান, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা আর গ্রামীণ মেলার আবহে সাজানো উৎসব চলবে রোববার (১৯ অক্টোবর) পর্যন্ত।
উদ্বোধনী দিনে লালন দর্শনের ওপর আয়োজিত আলোচনায় অংশ নেন দেশ-বিদেশের তাত্ত্বিক, গবেষক ও সাহিত্য বিশ্লেষকরা। তারা লালনের জীবনদর্শন, অসাম্প্রদায়িকতা এবং মানবিক চেতনা নিয়ে নানা দিক তুলে ধরেন। লালন যে কোনো ধর্ম বা বর্ণের ঊর্ধ্বে গিয়ে এক সার্বজনীন মানবিক বার্তা দিয়ে গেছেন—তা নিয়েই মূলত আলোচনা ঘনীভূত হয়।
আখড়াবাড়ি ও আশপাশের এলাকায় চলছে গভীর রাত অবধি লালনের গান। মঞ্চে একের পর এক উঠছেন বাউল সাধকরা, পরিবেশন করছেন লালনের বাণীতে ভরা দার্শনিক সংগীত। সমাধিসৌধের পাশের উন্মুক্ত শেডেও গেয়ে চলেছেন অনেকে, দর্শক-শ্রোতারা তন্ময় হয়ে শুনছেন।
উৎসবকে ঘিরে কালিগঙ্গা নদীর তীরবর্তী খোলা মাঠে বসেছে পাঁচ দিনের গ্রামীণ মেলা। এখানে স্থানীয় হস্তশিল্প, বাউল বাদ্যযন্ত্র, গ্রামীণ খাদ্য ও পোশাকের বাহারি দোকান বসেছে। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে তৈরি ১০০টি দৃষ্টিনন্দন স্টলে সরগরম বেচাকেনা চলছে।
উৎসব আয়োজকদের মতে, এবারের লালন স্মরণ উৎসবে লোকসমাগম ও মেলার জমজমাট পরিবেশ পূর্বের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে।
সাধু-বাউল ও সাধারণ মানুষের ঢল শুধু আখড়াবাড়ি এলাকায় থেমে থাকেনি। আখড়ার এক কিলোমিটার দূরের গড়াই নদীর পাড়েও রাত্রিযাপন করেছেন অনেকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগত জনস্রোত সামাল দিতে আখড়াবাড়ির এক কিলোমিটার আগেই যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছে। সড়কের দুই পাশে সারি সারি লোক ঘর বানিয়ে, কিংবা খোলা আকাশের নিচে চট পেতে রাত কাটাচ্ছেন।
শনিবার (১৮ অক্টোবর) সকালে ‘বাল্যসেবা’ পর্বে অনেকে সাধুসঙ্গের রীতি অনুসারে ‘ভেক গ্রহণ’ করেন। একত্রে পায়েস ও মুড়ি খেয়ে গান-বাজনার তাত্ত্বিক আলোচনা চলে।
দুপুরে হয় ‘পূর্ণসেবা’ পর্ব—সাদা ভাত, মাছ, ডাল, সবজি আর দই পরিবেশিত হয়। বিকেল গড়াতেই শুরু হয় নতুন করে গান আর বাণীবদ্ধ ভাব-সাধনার যাত্রা।
বাউলরা বলছেন, “গুরু-শিষ্য সম্পর্কের মধ্য দিয়ে যে আত্মিক প্রেম জাগে, তা খুঁজে নিতেই প্রতিবছর ছুটে আসি লালনের এই আখড়ায়। লালনের গান মানেই জীবনের এক গভীর আহ্বান।”
এবার প্রথমবারের মতো লালন স্মরণ উৎসব জাতীয় পর্যায়ে পালিত হচ্ছে। উৎসবের কেন্দ্রীয় আয়োজন তদারক করছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা, স্বাস্থ্যসেবা, যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও জরুরি সহায়তা ব্যবস্থার জন্য বিশেষ প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমির সভাপতি আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন বলেন, এই উৎসবকে ঘিরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছি। ভক্তদের নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
উৎসবে অংশ নেওয়া এক বাউল সাধু আলম বলেন, এই আয়োজন আরও আগেই রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেতে পারত। তবুও দেরিতে হলেও সরকার লালনের বাণীকে জাতীয় পরিসরে তুলে ধরেছে, তাতে আমরা খুশি।
বাউল সমাজের প্রাণপুরুষ ফকির লালন শাহের স্মরণে আয়োজিত এ উৎসব এখন আর শুধুই আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠান নয়—এটি পরিণত হয়েছে দেশের সংস্কৃতি, দর্শন ও মানবিক চেতনার এক অনন্য মিলনমেলায়। লাখো মানুষের পদচারণায় ছেঁউড়িয়া আবারও প্রমাণ করলো, লালনের গান আজও জীবনের বাণী, চেতনার উৎস আর সাম্যের আহ্বান।
 সর্বশেষ খবর পেতে  Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
    
    
    সর্বশেষ খবর পেতে  Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
    
মন্তব্য করুন
 
 
                    