সোমবার
১০ নভেম্বর ২০২৫, ২৬ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সোমবার
১০ নভেম্বর ২০২৫, ২৬ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পুরুষের অর্ধেক মজুরি নিয়েও কাজের আনন্দে ব্যস্ত নারীরা ‎ ‎

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৫, ০১:১৫ পিএম
কুড়িগ্রামে আগাম আলু চাষের প্রস্তুতি। ছবি: এনপিবি
expand
কুড়িগ্রামে আগাম আলু চাষের প্রস্তুতি। ছবি: এনপিবি

‎দুপুরের কড়া রোদ। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হোলখানা ইউনিয়নের মাষ্টারহাট গ্রামের ধরলাপাড়ার বিস্তীর্ণ বালুজমি জুড়ে চলছে আগাম আলু চাষের প্রস্তুতি।

মাঠে দেখা যায় হাসিনা বেগম (৩৪), ফুলবিবি (৩৯), মরিয়ম (২৮), আছিয়া বেগম (৪২)-সহ প্রায় ১০ জন নারী শ্রমিককে কেউ আলু কাটছে, কেউ মাঠে লাইন টানছে, আবার কেউ মাটিতে বীজ আলু রোপণ করছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের হাতে নেই অবসর। ‎ ‎তাদের প্রতিদিনের মজুরি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। তবুও মুখে ক্লান্তি নয়, বরং হাসির ঝিলিক। কারণ ‘মরা কার্তিকেও’ তারা কাজ পাচ্ছেন, সংসারে স্বামীর পাশে দাঁড়াতে পারছেন। এটাতেই তাদের তৃপ্তি ও আনন্দ। ‎ ‎নারী শ্রমিক ফুলবিবি বলেন, “আগে কার্তিক মাসে কাজ থাকত না, এখন আলু রোপণ করে কিছু টাকা রোজগার করতে পারছি। সংসারে সহায়তা করতে পারছি, সেটাই বড় কথা।” ‎ ‎কুড়িগ্রামসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে এখন আর মঙ্গার দৃশ্য নেই। সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেছে এখানকার মানুষের জীবনচিত্র। কৃষি নির্ভর এই অঞ্চলে আলুসহ নানা সবজি আবাদ হয় শীত মৌসুমে। পুরুষের পাশাপাশি হাজার হাজার নারী মাঠে নেমে সমানভাবে কাজ করছে। ধান কাটা, মাড়াই, আগাম আলু রোপণ, পাটের আঁশ তোলা সব কাজেই নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। ‎ ‎সারা বছর সংসারের কাজের পাশাপাশি জমিতে দিনমজুরি করেন তারা। তবে পুরুষের সমান পরিশ্রম করেও পান কম মজুরি। অথচ এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে তারা কোনো প্রতিবাদ করেন না; বরং ভয়ে থাকেন যদি কাজে না নেয় কেউ! ‎ ‎কুড়িগ্রাম জেলার নয়টি উপজেলার চর-দ্বীপচরসহ অন্তত ১২ ইউনিয়নে চলছে আগাম আলুর চাষ। জেলার ১৬টি নদনদীর অববাহিকায় ৪০৫টিরও বেশি চরে ধান, পাট ও আলুসহ নানা ফসল চাষ হয়। বিশেষ করে আগাম আলু রোপণে চলছে প্রতিযোগিতা কে আগে রোপণ করবে, কে আগে বাজারে আনবে। ‎ ‎কৃষকরা জানান, মাত্র ৫৫ থেকে ৬০ দিনের মধ্যেই আলু তোলা যায়। আগাম হওয়ায় বাজারে দামও ভালো থাকে। তবে গত বছর আলুর দাম পড়ে যাওয়ায় অনেকেই লোকসান গুনেছেন। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবার ধার-দেনা ও ব্যাংক লোন নিয়ে আবারও ঝুঁকেছেন আগাম আলু চাষে। ‎ ‎গত বছরের তুলনায় এবার চাষের পরিমাণ কিছুটা কম হলেও আশাবাদী কৃষকরা। কারণ কোল্ড স্টোরগুলোতে এখনো প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন আলু মজুত রয়েছে, যা বিক্রি শেষ হতে আরও কয়েক মাস লাগবে। ‎ ‎অন্যদিকে সার, ইউরিয়া, পটাশ, ডিএপি ও টিএসপির দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচও বেড়েছে। ফলে শ্রমিকদের মজুরিও সীমিত। পুরুষ শ্রমিকরা পাচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, নারীরা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। তবুও নারী শ্রমিকরা বলছেন, “এখন অন্তত কাজ আছে, ঘরে বসে থাকতে হয় না।” ‎ ‎তাদের বিশ্বাস, প্রকৃতি অনুকূলে থাকলে এবার আগাম আলুর বাম্পার ফলন হবে। আর দাম ভালো থাকলে তারা কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। ‎ ‎ ‎কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ-আল-মামুন বলেন,‎“কুড়িগ্রাম কৃষিনির্ভর জেলা। এখানে নারীরা পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। তাদের শ্রম ও অবদানেই কৃষিক্ষেত্রে এক ধরনের নীরব বিপ্লব ঘটেছে। আজ গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি এই নারীরাই।” ‎ ‎তিনি আরও বলেন, কৃষিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ যেমন বাড়ছে, তেমনি পরিবারেও তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‎ ‎এক সময় মঙ্গা ও দারিদ্র্যের প্রতীক ছিল কুড়িগ্রাম। আজ সেই কুড়িগ্রামের মাঠে মাঠে নারী শ্রমিকদের ঘাম ঝরছে আলুর আবাদে, আর সেই ঘামেই বদলে যাচ্ছে এ অঞ্চলের অর্থনীতি।

পুরুষের অর্ধেক মজুরি পেলেও নারীরা হার মানেনি বরং নিজের পরিশ্রম দিয়ে প্রমাণ করেছে, “কৃষক বাঁচলে, আমরা বাঁচব।”

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন