


গাজীপুর মহানগর পুলিশের নয়া পুলিশ কমিশনার মো: ইসরাইল হাওলাদার যোগদানের পর পরই মহানগরীর শিমুলতলী এলাকায় অবৈধভাবে চলমান আলোচিত-সমালোচিত কথিত অবৈধ ক্ষুদ্র ও কটির শিল্প মেলা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন।
তিনি সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে সাংবাদিকরা মেলা নিয়ে নানা অভিযোগ তুলে ধরার পর তাৎক্ষণিকভাবে এ ঘোষনা দেন।
রবিবার (২৩ নভেম্বর) সকাল ১১টায় গাজীপুর মহানগর পুলিশের হেডকোয়ার্টারের সম্মেলন কক্ষে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে অবৈধ ও অননুমোদিত মেলার বিষয়ে জানানো হয়, মেলাটি আয়োজনের জন্য প্রচলিত আইন অনুযায়ী জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অথবা মহানগর পুলিশসহ সরকারের কোন বিভাগ/দপ্তরের কাছ থেকে কোন প্রকান অনুমতি নেয়া হয়।
অবৈধ এ মেলা বন্ধের দাবীতে স্থানীয়রা মেলা বন্ধের দাবীতে আন্দোলন করেছেন, জেলা প্রশাসকের নিকট আবেদন করেছেন, ইতিপূরে জেলা প্রশাসক সরকারের মন্ত্রিসভা বিভাগ, মহানগর পুলিশসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি লিখেছন-কিন্তু কিছুতেই মেলাটি বন্ধে করা যাচ্ছিল না।
আরো অভিযোগ করা হয়, মেলায় লটারীর আড়ালে জুয়ার আয়োজন করা হচ্ছিল। মেলাটি নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত স্থানীয়রা আপত্তি জানিয়ে আসছিল। এরই ধারাবাহিকতায় গত শনিবার (২২ নভেম্বর) রাত সাড়ে ১১টার দিকে মহানগরীর শিমুলতলীতে আর্মি ফার্মা মাঠে অনুষ্ঠিত মেলায় হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটে।
সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ বলার সময়ে নয়া পুলিশ কমিশনার ঘোষণা করে বলেন, আপনাদের আমি জানাচ্ছি, গতরাতের ঘটনার পর আমরা মেলাটি বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
নয়া কমিশনারের এ ঘোষণার পর মতবিনিময় সভায় অংশ গ্রহণকারী সাংবিাদিকগণ করতালি দিয়ে কমিশনারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান।
একটি সূত্র জানায়, শীমুলতলীর মেলার বিষয়টি রোববার ঢাকায় কোর কমিটিতে আলোচিত হয়েছে। সেখানে একটি পক্ষ বলার চেষ্টা করে, মেলা আয়োজনে জেলা প্রশাসনের অনুমতি আছে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন অনুমতি না থাকার বিষয়টি জানানোর পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা তাৎক্ষণিকভাবে মেলা বন্ধের নির্দেশ প্রদান করেন। পরে বিষয়টি গাজীপুর সেনানিবাসের কর্মকর্তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, মহানগরীর শিমুলতলী এলাকায় সেনানিবাসের কাছে বিএমটিএফ লিমিটেড আর্মি ফার্মা ফ্যাক্টরির জন্য নির্ধারিত স্থানে অবৈধ ক্ষুদ্র ও কটির শিল্প মেলা আয়োজন করা হবে জানিয়ে গত ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির পক্ষে একটি অবহিতকরণ চিঠি বিতরণ করা হয়।
চিঠির বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে বিএনপিএফ লিমিটেড আর্মি ফার্ম্মা ফ্যাক্টরি নির্ধারিত ফাকা স্থানে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মেলার আয়োজন প্রসঙ্গে। বেনারশী ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের স্বত্বাধিকারী বাদল মিয়া “ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মেলার আয়োজক। কিন্তু মেলাটি আয়োজনের জন্য গাজীপুর জেলা প্রশাসন বা মহানগর পুলিশের কাছ থেকে কোন প্রকার অনুমতি নেয়া হয়নি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মেলা নাম দেওয়া হলেও এটির মূল্য উদ্দেশ্য লটারি বাণিজ্য ও জুয়া (হাউজি) খেলা। প্রতিদিন গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় দুই শতাধিক টিকিট বিক্রয় কর্মী অটোরিকশা, সিএনজি ও ট্রাক নিয়ে বেরিয়ে যেত।
সন্ধ্যায় প্রতিদিন বিক্রি হওয়া ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টিকিট (যার মুল্য ৯ থেকে সাড়ে ৯ লাখ টাকা) বাক্সে ভরে আনা হত মেলায়। লটারীতে জিতলে পাবে মোটরসাইকেল, স্বর্ণ, ল্যাপটপ, টিভি, ফ্রিজ, ডিনারসেটসহ নানা রকম পুরস্কারের প্রলোভন দেখিয়ে বিক্রি হতো প্রতিদিনি লাখ লাখ টাকার টিকিট।
ভাগ্য বদলের আশায় নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ বিশেষত রিকশা চালক ও দিনমজুর, বিভিন্ন ধরণের শ্রমিক শ্রেণির লোকজন মেলায় না এসেও অনেকে সরল বিশ্বাসে প্রতিদিনি শত শত কেউ হাজার টাকার লটারীর টিকিট কিনে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। হয়েছেন ড্র ও জুয়ায় আসক্ত।
অভিযোগ আছে, প্রকৃত মেলার ক্রেতারা লটারী পায় না। লটারি যারা পায়, তারা মেলার কর্তৃপক্ষের সাজানো লোকজন। দিনমজুর, রিকশাচালকসহ নিম্ন আয়ের মানুষজন, যারা স্বল্প টাকার বিনিময়ে ভাগ্য ফেরানোর আশায় টিকিট কিনেছে, তারা কিছুই পায়নি। এতে অনেক দরিদ্র পরিবার এভাবে ধ্বংসের পথে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির পক্ষে একটি একটি অবহিতকরণ চিঠি বিতরণ করা হয়। চিঠির বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে বিএনপিএফ লিমিটেড আর্মি ফার্ম্মা ফ্যাক্টরি নির্ধারিত ফাকা স্থানে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মেলার আয়োজন প্রসঙ্গে। এই চিঠিতে মেলা আয়োজনের জন্য কোন কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিয়েছে কিনা এ ধরনের কোন বিষয়ের উল্লেখ নেই।
চিঠিতে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেড, গাজীপুর সেনানিবাসের পক্ষে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পক্ষে মোঃ হুমায়ুন রাশেদ (কর্নেল) স্বাক্ষর করেছেন।
পরে গত ২০১৮ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মেলাটি উদ্বোধন করা হয়। এ সংক্রান্ত একটি দাওয়াত পত্রে দেখা যায়, এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএমটিএফ লিমিটেড এর অতিরিক্ত পরিচালক (প্রশাসন) কর্নেল মোঃ হুমায়ন রাশেদ পিএসসি।
স্থানীয়দের আরো অভিযোগ, অবৈধ এ মেলায় বিনোদনের নামে লটারীর আড়ালে জুয়ার পাশাপাশি অশ্লীল নাচগান চালিয়ে যুবসমাজকে নষ্ট করছে৷ এই মেলাতেই গত ৩০ সেপ্টম্বর নাগরদোলায় চড়ে হঠাৎ চলন্ত নাগরদোলা হেলে পড়ে অন্তত পাঁচজন আহত হয়েছেন।
এই মেলার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয় (ডুয়েট) এর সচেতন শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে গত ২১ সেপ্টেম্বর গাজীপুর জেলা প্রশাসক বরাবরের একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। স্মারকলিপিতে আর্মি ফার্মা মাঠে অনুষ্ঠিত মেলায় শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি প্রসঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানানো হয়। আবেদনে মেলার কারণে সামনের সড়কে যানজট, শব্দ দূষণের কারণে লেখাপড়া বিগ্ন হওয়াসহ কয়েকটি সমস্যার কথা তুলে ধরে মেলা বন্ধসহ চার দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, গাজীপুর মহানগরীর শিমুলতলী এলাকায় অবৈধ ক্ষুদ্র ও কটির শিল্প মেলার আড়ালে প্রতিরাতে বসানো হতো জুয়ার আসর, চলছিল লটারি নামে প্রতারণা। সেই মেলা বন্ধ করতে অনেক দেন দরবার করেও প্রতিকার না পেয়ে ঢাকা-গাজীপুর-শিমুলতলী সড়ক অবরোধ করে এই মেলা বন্ধের জন্য বিক্ষোভ করেন এলাকাবাসী ও মুসুল্লিরা৷
বিক্ষোভে অংশ নিয়ে শত শত এলাকাবাসী তখন অভিযোগ করেছিলেন, অবৈধভাবে আয়োজিত ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মেলাটি মূলত নামকাওয়াস্তে হলেও এর আড়ালে রয়েছে লটারি বাণিজ্য ও জুয়ার আসর। তারা আগামী ৩ দিনের মধ্যে যদি এই মেলা বন্ধ না করা হয় আমরা কঠোর পদক্ষেপের হুশিয়ারি দেন এলাকাবাসী।
গাজীপুর প্রশাসনের কার্যালয় সুত্রে জানা গেছে, মেলা পরিপত্র অনুযায়ী জেলা ও মহানগর এলাকায় এক মাসের জন্য মেলার অনুমতি দিতে পারেন জেলা প্রশাসক। কিন্তু এ মেলা আয়োজনের জন্য অনুমতির চেয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর কোনো আবেদই করেনি কর্তৃপক্ষ।
তারা একটি অবহিতকরণ চিঠি দিয়েছে। চিঠি পাওয়ার পর অননুমোদিত মেলা বন্ধ করার জন্য আমরা মহানগর পুলিশকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছি। ওই মেলার বিষয়ে পার্শ্ববর্তী ডুয়েটের শিক্ষার্থীরাও আপত্তি জানিয়ে জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছে।
এ বিষয়ে গাজীপুর মহানগর পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কমিশনার মোহাম্মদ জাহিদুল হাসান বলেন, মেলার অনুমতির জন্য আমাদের কাছে কেউ আবেদন করেনি। তাই আমরা কোনো অনুমতি দেইনি।
গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সালমা খাতুন বলেন, জেলা প্রশাসকের নিকট কেউ কোন আবেদন করেনি, তাই মেলা আয়োজনের অনুমতি দেয়ার প্রশ্ন অবান্তর।
মন্তব্য করুন