

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


সকালে হালকা কুয়াশা, ঘাসের ডগায়, গাছের পাতায় ঝলমলে শিশির বিন্দু আর দুপুরের মিষ্টি রোদ সাথে উত্তরের হিমেল হাওয়া জানিয়ে দিচ্ছে শীতের আগমন। প্রকৃতিতে এখন হেমন্তের মাঝামাঝি সময়। ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে খেজুরের রস- গুড় সংগ্রহের প্রস্তুতি। চলতি মওসুমে প্রায় ৭০ কোটি টাকার খেজুর গুড়ের বানিজ্য হবে চুয়াডাঙ্গায়।
চুয়াডাঙ্গার প্রায় প্রতিটি গ্রামের ক্ষেতের আইলে, রাস্তার ধারে, পুকুর পাড়ে অযত্নে, অবহেলায় বেড়ে ওঠা ৎেজুর গাছগুলো জেলার অর্থনীতিতে আর্শীবাদ। শীত মওসুমে এসব খেজুর গাছ থেকে রস গুড় উৎপাদন করে ৫/৬ মাস জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে কয়েক হাজার পরিবার।
জেলার চার উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গাছিদের ব্যস্ততা এখন চোখে পড়ার মতো। গাছের ডাল-পালা পরিষ্কার করে নলি লাগানোসহ খেজুর গাছ প্রস্তুতের কাজে দিনরাত ব্যস্ত তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় বর্তমানে ২ লাখ ৭১ হাজার ৯৬০টি খেজুর গাছ রয়েছে। প্রতিটি গাছ থেকে গড়ে ১০-১২ কেজি করে গুড় উৎপাদন করা সম্ভব। চলতি মৌসুমে খেজুরের গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৫০০ টন। যার বাজার মুল্য প্রায় ৭০ কোটি টাকা।
স্থানীয়রা জানান, খেজুর রস আহরণের মধ্য দিয়েই গ্রামীণ জনপদে শীতের আগমনী বার্তা শুরু হয়। বর্তমানে চলছে গাছ ঝোড়া ও পরিষ্কারের কাজ। বেড়েছে শীতের তীব্রতা। এখন শুরু হবে খেজুর গাছের বুক চিরে রস আহরন। যেসব এলাকায় বেশি খেজুর গাছ রয়েছে, সেখানে গাছিরা ইতোমধ্যেই অস্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করেছেন।
খেজুরা গ্রামের গাছি খুরশিদ আলম বলেন, খেজুর রস সংগ্রহের জন্য আমি প্রায় ১১৫ টি গাছ ঝোড়া ও পরিষ্কার করা শুরু করেছি। দুই সপ্তাহ পর নলি বসানোর কাজ শুরু হবে। একবার গাছ চাঁছলে তিন-চার দিন রস সংগ্রহ করা যায়, তারপর তিন দিন গাছ শুকাতে হয়। শীত যত বাড়বে, রস তত মিষ্টি হবে। রস সংগ্রহ করে আমরা পাটালি ও গুড় তৈরি করি, যা ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে।
ঈশ্বরচন্দ্রপুর গ্রামের গাছি গনি মিয়া জানান, ‘এই মৌসুমে আমি ৮০ টি খেজুর গাছ প্রস্তুত করেছি। আর দশ দিন পর নলি বসানো শুরু করব। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকেই রস সংগ্রহ করা যাবে। প্রতিটি গাছ থেকে ১০-১২ কেজি গুড় উৎপাদনের আশা করছি।’
আকন্দবাড়িয়া গ্রামের গাছি সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ৫ মাস গাছ কাটবো। খাটি গুড় তৈরী করি। চুয়াডাঙ্গার নলেন গুড় পাটালির চাহিদা ব্যাপক। এই গুড় পাটালি পেতে দু'দিন আগে সিরিয়াল দিতে হয়। অনেকেই অগ্রীম টাকা দিয়ে যায়। ২০০/- টাকা কেজি গুড় আর পাটালি ২৫০/- টাকা দরে বিক্রি করি। ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, নাটোর, পাবনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যাপারিরা আসে আমাদের গুড় পাটালি কিনতে।
অন্যদিকে সরোজগঞ্জ এলাকার গাছি আসাদুল হোসেন বলেন, ‘আমার ১৩০ টি গাছ প্রস্তুত করা শেষ হয়েছে। অগ্রহায়ণের শুরুতেই রস আহরণ শুরু করব। প্রতিটি গাছ থেকে প্রায় ১২-১৩ কেজি গুড় উৎপাদন সম্ভব। শীত বেশি পড়লে গুড়ের মান ভালো হয়। আমরা উৎপাদিত গুড় পার্শ্ববর্তী সরোজগঞ্জ বাজারে বিক্রি করি।’
দেশের সবচেয়ে বড় খেজুর গুড়ের হাট চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহী সরোজগঞ্জ বাজার এখন প্রস্তুত নতুন মৌসুমের জন্য। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে গাছিরা এখানে এসে তাদের তৈরি খাঁটি খেজুরের গুড় বিক্রি করে। গতবছর এখানে খেজুরের গুড় বিক্রি হয়েছিল ২২০-২৮০ টাকা কেজি দরে। আর পাটালি বিক্রি হয়েছিল ৩০০ টাকা দরে।
তবে ইদানীং অনেক গাছি খেজুরের গুড় তৈরীর করার সময় রস জ্বালানোর সময় চিনি মেশায়। এতে সুনাম নষ্ট হচ্ছে ঐতিহ্যবাহি এই খেজুর গুড়ের।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাসুদুর রহমান সরকার বলেন, গত বছর জেলায় গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছিল। এ বছরও ২ হাজার ৫০০ টন গুড় উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। শীতের তীব্রতা বাড়লে গাছিরা আরও ভালো মানের গুড় উৎপাদনে সক্ষম হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে খেজুরের রসে কোনো পাখি বা বাদুড় না বসে। প্রয়োজনে কলসির মুখে নেট দিতে হবে। আর গুড় তৈরীর সময় পরিমানে বেশি করতে অনেকই চিনি মেশান। চাষী ভাইদের বলবো - চিনি মিশিয়ে খেজুর গুড়ের সুনাম নষ্ট করবেন না। প্রয়োজনে দাম কয়েক টাকা বেশি নেন। কিন্তু ভেজাল করবেন না। এলাকার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে স্বাস্থ্যসম্মত ও মানসম্মত খেজুর গুড় উৎপাদন করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বেশি বেশি খেজুর গাছ লাগতে হবে। এতে একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে। অন্যদিকে রস-গুড় আহরন করে ৪/৫ মাস জীবন- জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন কৃষকরা।
মন্তব্য করুন