

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


রাজধানী ঢাকার হৃদয় বলা হয় গুলিস্তানকে-যে জায়গা ট্রাফিক, হকার, পথচারী আর যানবাহনের ভিড়ে দিন-রাত মুখরিত। কিন্তু খুব কম মানুষই জানেন, এই জনবহুল এলাকার নামের পেছনে রয়েছে এক আকর্ষণীয় ইতিহাস।
‘গুলিস্তান’ শব্দটি এসেছে ফারসি ভাষা থেকে, যার অর্থ “ফুলের বাগান।” তবে ঢাকায় তেমন কোনো সরকারি ফুলের বাগান কখনো ছিল না। বরং এই নামটি জনপ্রিয় হয় এখানকার এক বিখ্যাত সিনেমা হলের সূত্রে।
‘ঢাকাকোষ’ গ্রন্থে শরীফ উদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, গুলিস্তান সিনেমা হলের নামানুসারেই এলাকাটি ‘গুলিস্তান’ নামে পরিচিতি পায়।
ইতিহাস অনুযায়ী, ব্রিটিশ শাসনামলে এই অঞ্চলটি ছিল ঢাকার প্রাণকেন্দ্র। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে কলকাতা থেকে আসা চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী খান বাহাদুর ফজল আহমেদ দোশানি ১৯৫৩ সালে রমনা অঞ্চলে ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের উত্তরে ‘গুলিস্তান সিনেমা হল’ প্রতিষ্ঠা করেন।
এটি ছিল ঢাকার প্রথম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ। প্রথমে এর নাম ছিল লিবার্টি, পরে পরিবর্তন করে রাখা হয় গুলিস্তান। এর উদ্বোধন করেন আগা খান নিজে।
‘ঢাকাপুরাণ’-এর লেখক মিজানুর রহমান বর্ণনা করেছেন, সেই সময় গুলিস্তান এলাকার আশপাশে ছিল শুধু খোলা মাঠ ও কিছু ক্লাবঘর। সিনেমা হলের বিপরীতে ছিল ব্রিটানিয়া হল, আর আশপাশের পরিবেশ ছিল প্রায় নির্জন।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে গুলিস্তান হয়ে ওঠে ঢাকার চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। ১৯৫৫ সালে মূল ভবনের ওপরতলায় ‘নাজ’ নামে আরেকটি সিনেমা হল চালু হয়, যা তরুণ সমাজের আড্ডাস্থল হিসেবে খ্যাতি পায়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গুলিস্তান সিনেমা হলের মালিক পাকিস্তানে চলে গেলে ভবনটি সরকার ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তি’ ঘোষণা করে। ১৯৭২ সালে এটি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের আওতায় আনা হয়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সিনেমা হলের যুগ শেষ হয়। ২০০৫ সালে পুরনো ভবনটি ভেঙে সেখানে গড়ে ওঠে আধুনিক শপিং কমপ্লেক্স, যা আজকের গুলিস্তান মার্কেট হিসেবে পরিচিত।
বর্তমানে গুলিস্তান ঢাকার সবচেয়ে ব্যস্ত সড়কসংযোগস্থলগুলোর একটি। এখান দিয়ে প্রতিদিন লাখো মানুষ চলাচল করেন। সড়কের দুই পাশে সারি সারি পাইকারি ও খুচরা দোকান, যা দেশের পোশাক বাণিজ্যের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে।
এখানেই অবস্থিত ঐতিহাসিক গোলাপ শাহের মাজার, যেখানে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ভক্তি নিবেদন করতে আসেন। পাশাপাশি কাছাকাছি রয়েছে বঙ্গবাজার, স্বল্পমূল্যে পোশাক কেনার অন্যতম জনপ্রিয় স্থান।
যানজট নিরসন ও দ্রুত যাতায়াতের জন্য ২০১৩ সালে উদ্বোধন হয় গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী উড়ালসড়ক, যা রাজধানীর যোগাযোগে নতুন গতি এনেছে। আশপাশে আছে ওসমানী উদ্যান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন কার্যালয়, ঢাকা জিপিও, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম এবং বায়তুল মোকাররম মসজিদ-সবই গুলিস্তানকে দিয়েছে অনন্য গুরুত্ব।
এক সময়ের ‘ফুলের বাগান’ আজ পরিণত হয়েছে ঢাকার জনজীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে। সময়ের সঙ্গে রূপ বদলেও গুলিস্তান এখনও ঢাকার স্পন্দিত হৃদয়ের প্রতীক-যেখানে ইতিহাস, বাণিজ্য ও সংস্কৃতি একসূত্রে গাঁথা।
মন্তব্য করুন