রবিবার
১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
রবিবার
১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইতিহাসের অবধারিত গন্তব্যে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন!

মুহাম্মদ বাকের হোসাইন
প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:০৭ পিএম
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজের লোগো
expand
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজের লোগো

১৯৯২ সালে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজের বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তখন অবিভক্ত ডিইউজের সভাপতি ছিলেন জহিরুল হক আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন রুহুল আমিন গাজী। বেগম খালেদা জিয়া বক্তব্য রাখার সময় আওয়ামী লীগের অনুসারী সাংবাদিকদের নেতা শাহজাহান মিয়ারা বুকে কালো ব্যাজ পরে অনুষ্ঠানে অবস্থান নেন। ডিইউজের নেতৃত্ব এতে বিব্রতবোধ করেন। তাঁরা কালো ব্যাজধারীদের অনুরোধ করে এই কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এজিএমের পর জাতীয়তাবাদী ফোরামে এনিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতির এক পর্যায়ে ডিইউজে ভেঙে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। ইউনিয়ন ভাঙ্গার দায় কার কতো শতাংশ সে বিচারে এখন যাবো না তবে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বলতে হয় একহাতে তালি বাজেনি। একপক্ষ উসকানি দি…

১৯৯২ সালে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজের বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তখন অবিভক্ত ডিইউজের সভাপতি ছিলেন জহিরুল হক আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন রুহুল আমিন গাজী। বেগম খালেদা জিয়া বক্তব্য রাখার সময় আওয়ামী লীগের অনুসারী সাংবাদিকদের নেতা শাহজাহান মিয়ারা বুকে কালো ব্যাজ পরে অনুষ্ঠানে অবস্থান নেন। ডিইউজের নেতৃত্ব এতে বিব্রতবোধ করেন। তাঁরা কালো ব্যাজধারীদের অনুরোধ করে এই কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এজিএমের পর জাতীয়তাবাদী ফোরামে এনিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতির এক পর্যায়ে ডিইউজে ভেঙে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। ইউনিয়ন ভাঙ্গার দায় কার কতো শতাংশ সে বিচারে এখন যাবো না তবে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বলতে হয় একহাতে তালি বাজেনি। একপক্ষ উসকানি দিলেও অন্যপক্ষ একটু ধৈর্যের পরিচয় দিলে ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হতো কিন্তু পৃথিবীতে যতো ভাঙ্গাগড়া হয় তাতো ক্ষমতাবানদের স্বার্থেই হয়,সাধারণ মানুষ ইতিহাসের নীরব দর্শক অথবা সাক্ষীগোপাল মাত্র। এজন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাও তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক আমলাদের মধ্যকার স্বার্থ সংঘাতের ফল। ডিইউজের ঘটনাও তাই। একপক্ষের নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখা, আরেক পক্ষের নেতৃত্ব দখল এই দুই বিপরীতমুখী স্বার্থের দ্বন্দ্বে বলীর পাঁঠা হয় ডিইউজে এবং সাধারণ সদস্যরা। ইউনিয়ন বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পর জাতীয়তাবাদী ফোরামের নেতারা বাহবা নেয়া এবং তোয়াজের মানসে বেগম খালেদা জিয়ার কাছে গিয়ে বলেন সেদিন এজিএমে কালোব্যাজ পরে আওয়ামী সাংবাদিকরা আপনাকে অপমান করার কারণে আমরা ইউনিয়নে পৃথক অবস্থান নিয়েছি,বাকশালীদের সাথে আর সহাবস্থান সঠিক মনে করিনি । বেগম খালেদা জিয়া নেতাদের এই কথা শুনে মর্মাহত হয়ে বলেন তিনি গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী, তাঁকে কেউ ফুলের মালা দিবে আর কেউ তাঁর সামনে কালোব্যাজ পরবে, এটাই তো স্বাভাবিক কিন্তু এজন্য একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ভেঙে দিতে হবে এমন সিদ্ধান্ত তিনি সঠিক মনে করেন না।

তিনিই হচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া এবং এজন্যই তিনি আজ জাতীয় ঐক্যের প্রতীক,বিশকোটি বাংলাদেশীর নয়নমণি। আজ তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। সমগ্র দেশবাসীর সাথে আমরাও মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানাই হে পরওয়ারদিগারে আলম মেহেরবানি করে আপনি আমাদের নেত্রীকে হায়াতে তাইয়েবা ইনায়েত করুন, তাঁকে পূর্ণ ও আশু সুস্থ করে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিন। তিনি যেনো এই হতভাগা দেশ ও জাতিকে সঙ্কট থেকে রক্ষা করতে পারেন সেই তাওফিক আপনি তাঁকে দিন,আমিন।

ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় সাংবাদিক সমাজের অবস্থা কি দাঁড়িয়েছে তা কি বলার দরকার আছে? মোটেই না।তবে এককথায় বললে তা হবে বেকারি শ্রমিকের চাইতেও খারাপ। এজন্য তেত্রিশ বছর পরে এসেও ইউনিয়ন ভাঙ্গার নাটের গুরুদের লানত দিই,ধিক্কার জানাই। কালোব্যাজ পরার ঘটনা ইউনিয়ন ভাঙ্গার পেছনে তাৎক্ষণিকভাবে কাজ করলেও এই রোগের উৎপত্তি বেশ কিছুদিন আগে থেকে। এর মূল কারণ ছিলো ভোটার তালিকা। এনিয়ে বিরোধ এমন এক বিষাক্ত অবস্থায় চলে যায় যা ধারণ করা আর সম্ভবপর হয়নি। এজন্য দরকার ছিলো ভোটার তালিকার সুষম,যৌক্তিক ও ইনসাফপূর্ণ সংস্কার। সেটা না হওয়ায় একপক্ষের মধ্যে বঞ্চনার অনুভব তীব্র হয়,যার আঘাতে ডিইউজে দু'টুকরো হয়ে যায় এবং ডিইউজের পথ ধরে পরবর্তীতে বিএফইউজেও দু'খান হয়ে যায়। প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যে প্রত্যেকটি সংগঠন আলাদা হতে পারে কিন্তু একটি মূলগত সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সংগঠন পাহাড়ে মাটির গাঁথুনির মতো ব্যাপার।পাহাড়ের গাছগাছালি মাটির গাঁথুনিকে আটকে রাখে। তাই গাছ ও লতাপাতা যখন উজাড় করে ফেলা হয় তখন গাঁথুনি দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই দুর্বল গাঁথুনির ফাঁকে বৃষ্টির পানি বা বন্যার ছোবল পড়লে বা গোড়ার মাটি কেটে নেয়া হলে পাহাড় ধসে পড়ে। তেমনি সংগঠনের নেতৃত্ব যদি নিজেদের প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি দিয়ে সংগঠনে সমতা ও ইনসাফ কায়েম না করে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সব সিদ্ধান্ত নেন তাহলে সংগঠনের সংহতি দুর্বল হয়ে পরস্পর অনাস্থা তৈরি হয়। এটা তাদেরকে ভিন্ন পথ ধরতে প্ররোচিত করে।

সাংবাদিক ইউনিয়ন সদস্যদের মধ্যে নানা মত,পথ ও রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার লোক থাকবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু তাদের পরিচয় তারা সাংবাদিক,দলীয় কর্মী নয়। তিনি নিজের মতামত প্রকাশ বা ভোট দান করবেন তার পেশাগত স্বার্থ দেখে। তাই সাংবাদিক সংগঠনে বিএনপি সমর্থক সদস্যের ভোটে জামায়াত সমর্থক প্রার্থী বা আওয়ামী লীগ সমর্থক সদস্যের ভোটে বিএনপি সমর্থক প্রার্থী জয়ী হওয়া সাধারণ ঘটনা। কিন্তু দলীয় পরিচয় যদি সাংবাদিক পরিচয়ের চাইতে মুখ্য হয়ে যায় তাহলে সেখানে পরিবেশ সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে যেতে বাধ্য। এজন্য সাংবাদিক ছাড়া দলীয় কর্মীদের ডিইউজের সদস্যপদ দেয়া শুধু অনৈতিক নয়,ডিইউজের গঠনতন্ত্রের গুরুতর লংঘন। একপক্ষ দল ভারি করা এবং ভোট বাড়ানোর জন্য এই অন্যায় কাজ করলে অন্যপক্ষও সেপথ ধরবেই। ফলে সেখানে গণতন্ত্র চর্চার পরিবর্তে চর দখলের পরিবেশ তৈরি হবে। ডিইউজে বর্তমানে এই সঙ্কটের মুখে পড়েছে। ডিইউজের সমস্যা সমাধানের জন্য এখন সদস্যরা নিজের রাজনৈতিক দলের অফিসে ধর্ণা দিচ্ছেন আর রাজনৈতিক দলের নেতারা ইউনিয়নে তাঁদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছেন,যা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতি ডিইউজের জন্য অশনিসংকেত। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ একটা অবিলম্বে রাজনৈতিক দলের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে এবং ডিইউজেকে মজবুত সাংবাদিক সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায় সীমাহীন খেসারত দেয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না।

৩৬ জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা বুঝে না বুঝে বা আবেগবশত আরো কিছু ভুল করেছি বলে মনে হয়। আমরা সহযোগী সাংবাদিক ইউনিয়নের কাজ বাধাগ্রস্ত করছি। আমরা কি মনে রেখেছি আমাদের ডিইউজের নিবন্ধন আছে, কিন্তু আদালতের রায় অনুযায়ী নাম ব্যবহারের অধিকার তাদের। আমরা নাম ব্যবহারের (টাইটেল স্যুট) মামলায় হেরে গিয়েছি। মরহুম রুহুল আমিন গাজী আওয়ামী বন্ধুদের সাথে সমঝোতা করে কেউ কাউকে না ঘাটানোর অবস্থায় উপনীত হয়েছি। এখন তারা ডিইউজে করে আদালতের রায়ে আর আমরা করি নিবন্ধনের বদৌলতে। সেজন্য আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনেও তারা আমাদের নিবন্ধন বাতিলের চিন্তা করেননি বরং আমাদের একটি ফেরকা একসময় ইউনিয়ন দখল করে নিলেও তারা সেই সুযোগ না নিয়ে আমাদেরকে সহযোগিতা করেছেন।আজকে আমাদেরও সবকিছু দূরদৃষ্টি নিয়ে ভেবে কর্মপন্থা ঠিক করতে হবে,অন্যথায় আমাদের ডিইউজের জন্য বাড়তি ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

আবার সেই পাহাড়ের কথায় আসি।পাহাড় ধস ঠেকাতে হলে যেমন দরকার শক্ত দেয়াল দিয়ে খালি জায়গা ভরাট করে ফেলা,যাতে গাঁথুনি শক্ত হয় আর মাটি সরতে না পারে, তেমনি ইউনিয়নের ক্ষয় রোধ করতে হলেও দরকার দ্বিধাবিভক্ত ডিইউজেকে ঐক্যবদ্ধ করে ফেলা। এতে ডিইউজে রক্ষা পাবে ক্ষয়িষ্ণুতা থেকে আর আমরা নাজাত পাবো দুর্দশা থেকে। তখন আমাদের বন্ধু থাকবে,কিন্তু আমাদের উপর ছড়ি ঘোরানোর মতো কোনো প্রভু থাকবে না। এটাই এখন সময়ের অনিবার্য দাবি। এ দাবি পূরণ করতে না পারলে ডিইউজে বলুন আর বিএফইউজে বলুন একদিন সবই জাদুঘরের সম্পদ হয়ে যেতে পারে।

সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবিতে গড়ে উঠা দুই ইউনিয়নের মধ্যকার বোঝাপড়া বাস্তবায়িত হলে এতোদিনে ইউনিয়ন তো এক হয়েই যেতো,সেটা না হলেও সাংবাদিক সমাজ ও পেশা বাঁচাতে অন্য কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। সময় সুযোগ হলে এই লেখার সাথে সেই বোঝাপড়ার মুসাবিদা সংযুক্ত করে দেয়ার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ,

মুহাম্মদ বাকের হোসাইন সাবেক সাধারণ সম্পাদক ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজে

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

X