রবিবার
১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
রবিবার
১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দাউদের সবচেয়ে ভালো মলম: বিশেষজ্ঞের নির্দেশনা ও কার্যকর সমাধান

এনপিবি ডেস্ক
প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৫৮ পিএম আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৫৯ পিএম
expand
দাউদের সবচেয়ে ভালো মলম: বিশেষজ্ঞের নির্দেশনা ও কার্যকর সমাধান

দাউদ বা রিংওয়ার্ম (Ringworm) একটি সাধারণ ছত্রাকজনিত ত্বকের সংক্রমণ যা চুলকানি, লালচে র‍্যাশ এবং অস্বস্তি সৃষ্টি করে। অনেকেই দাউদের চিকিৎসায় কোন মলমটি সবচেয়ে ভালো, তা নিয়ে দ্বিধায় ভোগেন এবং ভুল মলম ব্যবহারের কারণে রোগটি আরও জটিল করে তোলেন।

এই পোস্টে, দাউদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত সেরা মলমগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে, কখন কোন মলম ব্যবহার করা উচিত এবং ভুল চিকিৎসার বিপদগুলো কী কী।

দাউদের চিকিৎসায় মলমের ভূমিকা

দাউদ মূলত ত্বকের উপরিভাগে (Superficial Fungal Infection) হয়ে থাকে, তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টপিক্যাল অ্যান্টিফাঙ্গাল মলম বা ক্রিম এর চিকিৎসায় অত্যন্ত কার্যকর [1]। এই মলমগুলো ছত্রাকের বৃদ্ধি বন্ধ করে বা ছত্রাককে সরাসরি মেরে ফেলে কাজ করে। তবে, সঠিক মলম নির্বাচন এবং সঠিক উপায়ে ব্যবহার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দাউদের জন্য সেরা অ্যান্টিফাঙ্গাল মলমগুলো (Best Antifungal Creams for Ringworm)

সাধারণত, দাউদের চিকিৎসায় দুই ধরনের অ্যান্টিফাঙ্গাল মলম ব্যবহার করা হয়: অ্যাজোলস (Azoles) এবং অ্যালাইলামিনস (Allylamines)।

১. অ্যালাইলামিনস (Allylamines): এই গ্রুপের মলমগুলো ছত্রাককে সরাসরি মেরে ফেলতে (fungicidal) বিশেষভাবে কার্যকর এবং তুলনামূলকভাবে দ্রুত কাজ করে [2, 3]।

টার্বিনাফাইন (Terbinafine):

বাণিজ্যিক নাম: ল্যামিসিল (Lamisil) বা জেনেরিক টার্বিনাফাইন ক্রিম।

কার্যকারিতা: এটি দাউদের চিকিৎসায় সবচেয়ে শক্তিশালী এবং দ্রুত কার্যকর মলমগুলোর মধ্যে অন্যতম [4]। এটি ছত্রাকের কোষ প্রাচীর তৈরিতে বাধা দিয়ে তাদের ধ্বংস করে।

ব্যবহার: সাধারণত দিনে একবার প্রয়োগ করতে হয়। সংক্রমণের তীব্রতা ও স্থান ভেদে ১ থেকে ২ সপ্তাহ ব্যবহার করলেই ভালো ফলাফল পাওয়া যায় [5]। এটি ত্বকের সাধারণ দাউদ, কুঁচকির দাউদ (Tinea Cruris) এবং পায়ের দাউদ (Athlete's Foot) এর জন্য খুবই ভালো কাজ করে।

২. অ্যাজোলস (Azoles): এই গ্রুপের মলমগুলো ছত্রাকের বৃদ্ধিকে বাধা দিয়ে (fungistatic) কাজ করে, যার ফলে ছত্রাক ধীরে ধীরে মারা যায় [2, 3]। এগুলো তুলনামূলকভাবে ধীরগতিতে কাজ করলেও বিস্তৃত পরিসরের ছত্রাক সংক্রমণের জন্য কার্যকর।

ক্লট্রিমাজোল (Clotrimazole):

বাণিজ্যিক নাম: লোট্রিমিন (Lotrimin), ক্যানিস্টেন (Canesten) বা জেনেরিক ক্লট্রিমাজোল ক্রিম।

কার্যকারিতা: এটি একটি বহুল ব্যবহৃত এবং নিরাপদ অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্রিম। এটি ছত্রাকের কোষ পর্দার গঠনে ব্যাঘাত ঘটায়।

  • ব্যবহার: সাধারণত দিনে দুইবার প্রয়োগ করতে হয়। ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত ব্যবহার করার প্রয়োজন হতে পারে [6]।

মাইকোনাজোল (Miconazole):

  • বাণিজ্যিক নাম: ডেসেনেক্স (Desenex), মিকোনাজ (Miconaz) বা জেনেরিক মাইকোনাজোল ক্রিম।

  • কার্যকারিতা: ক্লট্রিমাজোলের মতোই কাজ করে এবং একই ধরনের ছত্রাক সংক্রমণের জন্য কার্যকর।

  • ব্যবহার: সাধারণত দিনে দুইবার প্রয়োগ করতে হয়। ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে [7]।

কেটোকোনাজোল (Ketoconazole):

  • বাণিজ্যিক নাম: নিজোরাল (Nizoral) বা জেনেরিক কেটোকোনাজোল ক্রিম।

  • কার্যকারিতা: এটি আরও শক্তিশালী একটি অ্যাজোল অ্যান্টিফাঙ্গাল।

  • ব্যবহার: সাধারণত দিনে একবার প্রয়োগ করতে হয়। ২ থেকে ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে [8]।

কখন মুখে খাওয়ার ঔষধের প্রয়োজন? (When Oral Medication is Needed?)

কিছু ক্ষেত্রে শুধু মলমে কাজ হয় না এবং মুখে খাওয়ার অ্যান্টিফাঙ্গাল ঔষধের প্রয়োজন হয় [9]:

  • মাথার ত্বকের দাউদ (Tinea Capitis): এই ক্ষেত্রে মলম চুলের ফলিকলে পৌঁছাতে পারে না, তাই মুখে খাওয়ার ঔষধ অপরিহার্য [10]।

  • নখের দাউদ (Tinea Unguium): নখের গভীরে সংক্রমণ থাকে বলে মলম দিয়ে এর চিকিৎসা সম্ভব হয় না [11]।

  • ব্যাপক বা গুরুতর সংক্রমণ: যদি দাউদ শরীরের বিশাল অংশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বা তীব্র আকার ধারণ করে।

  • দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা: যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তাদের ক্ষেত্রে মুখে খাওয়ার ঔষধের প্রয়োজন হতে পারে।

  • মলমে কাজ না হলে: যদি ২-৪ সপ্তাহ মলম ব্যবহারের পরও দাউদ না সারে।

এই ক্ষেত্রে টার্বিনাফাইন (Terbinafine), ফ্লুকোনাজোল (Fluconazole) বা ইট্রাকোনাজোল (Itraconazole) এর মতো ঔষধ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করতে হয় [9, 12]।

সবচেয়ে বড় ভুল: স্টেরয়েডযুক্ত মলম থেকে সাবধান!

দাউদের চিকিৎসায় সবচেয়ে মারাত্মক ভুল হলো স্টেরয়েডযুক্ত মলম ব্যবহার করা। বাজারে অনেক কম্বিনেশন ক্রিম পাওয়া যায়, যেগুলোতে অ্যান্টিফাঙ্গাল উপাদানের সাথে শক্তিশালী স্টেরয়েড (যেমন: বিটামিথাসন, ক্লোবিটাসল) মেশানো থাকে। এই ক্রিমগুলো সাময়িকভাবে চুলকানি ও লালচে ভাব কমিয়ে দিলেও, স্টেরয়েড ত্বকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দমন করে ছত্রাকের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে [13, 14]।

এর ফলে দাউদের ক্লাসিক রূপটি পরিবর্তিত হয়ে যায়, যাকে "টিনিয়া ইনকগনিটো" (Tinea Incognito) বলা হয়। এতে রোগটি আরও গভীরে ছড়িয়ে পড়ে, অনেক বেশি মারাত্মক হয় এবং সাধারণ অ্যান্টিফাঙ্গাল চিকিৎসায় সারতে চায় না [13]। তাই, যেকোনো মলম ব্যবহারের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

মলম ব্যবহারের সঠিক নিয়মাবলী (Proper Application of Creams)

সঠিকভাবে মলম ব্যবহার করলে দ্রুত আরোগ্য লাভ করা সম্ভব:

  1. পরিষ্কার ও শুকনো: আক্রান্ত স্থানটি হালকা সাবান ও পানি দিয়ে ধুয়ে ভালোভাবে শুকিয়ে নিন। আর্দ্রতা ছত্রাকের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে।

  2. পাতলা স্তর: মলমের একটি পাতলা স্তর আক্রান্ত স্থানে এবং এর চারপাশে প্রায় ১ ইঞ্চি সুস্থ ত্বকেও লাগান।

  3. নিয়মিত ব্যবহার: চিকিৎসকের নির্দেশ অনুযায়ী দিনে এক বা দুইবার নিয়মিত ব্যবহার করুন।

  4. কোর্স সম্পূর্ণ করুন: চুলকানি বা র‍্যাশ চলে গেলেও চিকিৎসকের নির্দেশিত পুরো কোর্স (সাধারণত ২-৪ সপ্তাহ) সম্পূর্ণ করুন, যাতে ছত্রাক পুরোপুরি নির্মূল হয় এবং রোগটি পুনরায় ফিরে না আসে [6]।

কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন? (When to See a Doctor?)

  • যদি ২ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ওভার-দ্য-কাউন্টার (OTC) মলম ব্যবহারের পরও দাউদ না সারে বা আরও খারাপ হয়।

  • যদি মাথার ত্বক বা নখে সংক্রমণ হয়।

  • যদি দাউদের সাথে জ্বর, পুঁজ বা তীব্র ব্যথা থাকে।

  • যদি আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকে।

দাউদের চিকিৎসায় সঠিক মলম নির্বাচন এবং নিয়ম মেনে ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি। টার্বিনাফাইন, ক্লট্রিমাজোল, মাইকোনাজোল বা কেটোকোনাজোল এর মতো অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্রিমগুলো সাধারণত নিরাপদ ও কার্যকর।

তবে, ভুল করে স্টেরয়েডযুক্ত মলম ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। সবসময় একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করুন এবং পুরো ঔষধের কোর্স সম্পূর্ণ করুন। সঠিক জ্ঞান এবং সতর্কতাই দাউদমুক্ত সুস্থ জীবন নিশ্চিত করতে পারে।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী

প্রশ্ন ১: দাউদের জন্য সবচেয়ে ভালো মলম কোনটি? উত্তর: ত্বকের সাধারণ দাউদের জন্য টার্বিনাফাইন (যেমন: ল্যামিসিল) এবং ক্লট্রিমাজোল (যেমন: লোট্রিমিন) সবচেয়ে কার্যকর ও বহুল ব্যবহৃত মলম। টার্বিনাফাইন সাধারণত দ্রুত কাজ করে। তবে, আপনার জন্য কোনটি সবচেয়ে ভালো হবে, তা আপনার ত্বকের অবস্থা এবং সংক্রমণের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে, তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

প্রশ্ন ২: মলম লাগানোর কতদিন পর দাউদ কমে যাবে? উত্তর: টার্বিনাফাইন এর মতো শক্তিশালী মলম ব্যবহার করলে সাধারণত কয়েক দিনের মধ্যেই চুলকানি ও লালচে ভাব কমতে শুরু করে। সম্পূর্ণভাবে সেরে উঠতে ১-২ সপ্তাহ লাগতে পারে। ক্লট্রিমাজোল বা মাইকোনাজোল এর মতো মলমে কিছুটা বেশি সময়, প্রায় ২-৪ সপ্তাহ লাগতে পারে।

প্রশ্ন ৩: দাউদ চলে যাওয়ার পরও কি মলম ব্যবহার করা চালিয়ে যাব? উত্তর: হ্যাঁ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকের নির্দেশ অনুযায়ী নির্ধারিত সময় পর্যন্ত (সাধারণত উপসর্গ চলে যাওয়ার পরও ১-২ সপ্তাহ) মলম ব্যবহার চালিয়ে যাওয়া উচিত। এতে ছত্রাক পুরোপুরি নির্মূল হয় এবং পুনরায় সংক্রমণের ঝুঁকি কমে।

প্রশ্ন ৪: কোন ধরনের মলম দাউদের জন্য বিপজ্জনক? উত্তর: স্টেরয়েডযুক্ত মলম দাউদের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। যেমন: Betamethasone, Clobetasol বা Fluocinolone এর মতো স্টেরয়েড উপাদানযুক্ত ক্রিমগুলো সাময়িকভাবে চুলকানি কমালেও ছত্রাকের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে এবং সংক্রমণকে আরও জটিল করে তোলে ("টিনিয়া ইনকগনিটো")।

প্রশ্ন ৫: শুধু মলম দিয়ে কি মাথার দাউদ বা নখের দাউদ সারানো যায়? উত্তর: সাধারণত না। মাথার ত্বকের দাউদ (Tinea Capitis) এবং নখের দাউদ (Tinea Unguium) এর জন্য মুখে খাওয়ার অ্যান্টিফাঙ্গাল ঔষধের প্রয়োজন হয়, কারণ মলম এই গভীর সংক্রমণগুলোতে পৌঁছাতে পারে না। এই ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

তথ্যসূত্র (References):

  1. American Academy of Dermatology (AAD). (n.d.). Ringworm: Treatment. Retrieved from https://www.aad.org/public/diseases/a-z/ringworm-treatment
  2. Ely, J. W., Rosenfeld, S., & Stone, M. S. (2014). Diagnosis and management of common tinea infections. American Family Physician, 90(11), 702-710.
  3. Gupta, A. K., & Cooper, E. A. (2008). Update in antifungal therapy of dermatophytosis. Mycopathologia, 166(5-6), 353-367.
  4. Terbinafine. (2023). In StatPearls. StatPearls Publishing. Retrieved from https://www.ncbi.nlm.nih.gov/books/NBK545199/
  5. Lamisil (Terbinafine) Cream prescribing information. (n.d.).
  6. Clotrimazole. (2023). In StatPearls. StatPearls Publishing. Retrieved from https://www.ncbi.nlm.nih.gov/books/NBK559286/
  7. Miconazole. (2023). In StatPearls. StatPearls Publishing. Retrieved from https://www.ncbi.nlm.nih.gov/books/NBK557616/
  8. Ketoconazole. (2023). In StatPearls. StatPearls Publishing. Retrieved from https://www.ncbi.nlm.nih.gov/books/NBK559258/
  9. Centers for Disease Control and Prevention (CDC). (2021). Fungal Diseases: Ringworm. Retrieved from https://www.cdc.gov/fungal/diseases/ringworm/index.html
  10. Sahoo, A. K., & Mahajan, V. K. (2016). Management of tinea capitis: An update. Indian Dermatology Online Journal, 7(4), 226-235.
  11. Westerberg, L., & Monti, M. (2010). Onychomycosis: Risk factors and treatment options. The Journal of Dermatology, 37(6), 499-506.
  12. Mayo Clinic. (2022). Ringworm (body) - Symptoms and causes. Retrieved from https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/ringworm-body/symptoms-causes/syc-20354921
  13. Ramesha, A., & Adarsh, N. (2017). Tinea Incognito. Journal of Pakistan Association of Dermatologists, 27(4), 362-364.
  14. World Health Organization (WHO). (n.d.). Dermatophytosis (tinea). Retrieved from https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/dermatophytosis-(tinea)
google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

X