শনিবার
০১ নভেম্বর ২০২৫, ১৭ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শনিবার
০১ নভেম্বর ২০২৫, ১৭ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সমুদ্রে তলে সোনার খনি, কিন্তু উত্তোলন কি আদৌ সম্ভব?

এনপিবি ডেস্ক
প্রকাশ : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৪২ পিএম
সমুদ্রের গভীর
expand
সমুদ্রের গভীর

পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৭০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে সমুদ্র। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিপুল জলরাশির প্রায় ৮০ শতাংশই এখনো অনাবিষ্কৃত ও অজানা। সেই অগাধ সমুদ্রের গভীরে লুকিয়ে আছে এমন সম্পদ, যার মূল্য বিশ্বের সব দেশের সম্মিলিত জিডিপিকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। মহাসাগরের তলদেশে থাকা সেই অমূল্য ভাণ্ডার যদি কাজে লাগানো যায়, তবে বৈশ্বিক অর্থনীতির চিত্র আমূল বদলে যেতে পারে।

সমুদ্রের অতল গহীনে লুকিয়ে আছে সোনার বিপুল ভাণ্ডার। এক-দু’টি নয়, বরং লক্ষ লক্ষ টন সোনা মিশে আছে সমুদ্রের পানিতে। বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্য।

গবেষকদের মতে, সমুদ্রের তলদেশে অন্তত ২ কোটি টনেরও বেশি সোনা বিদ্যমান, যা পানি দ্রবীভূত অবস্থায় ছড়িয়ে আছে। যেন সমুদ্র নিজেই হয়ে উঠেছে এক অদৃশ্য কুবেরের ভাণ্ডার।

আমেরিকার ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দীর্ঘ কয়েক বছরের গবেষণা ও অভিযানের পর এক চমকপ্রদ তথ্য প্রকাশ করে। আটলান্টিক মহাসাগরের গভীরে পরিচালিত সেই অভিযানে জানা যায়, সমুদ্রের নোনা জলে লুকিয়ে আছে কয়েক কোটি কোটি ডলারের সমমূল্যের অমূল্য সম্পদ।

বিজ্ঞানীদের অনুমান অনুযায়ী, সমুদ্রের তলায় জমা সোনার সম্ভাব্য বাজারমূল্য হতে পারে প্রায় ২ কোয়াড্রিলিয়ন ডলার-অর্থাৎ প্রায় ২০ কোটি কোটি ডলার। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে এই মূল্য আরও বাড়বে। যদি এ সম্পদ কখনও উত্তোলন করা সম্ভব হয়, তবে তা বিশ্বব্যাপী সোনার চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করতে পারবে।

তবে সমুদ্র থেকে সোনা আহরণ কোনোভাবেই সহজ নয়। লবণাক্ত জল থেকে সোনা আলাদা করা জটিল ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। ধারণা করা হয়, প্রায় ১০০০ লক্ষ মেট্রিক টন সমুদ্রপানি থেকে মাত্র এক গ্রাম সোনা পাওয়া সম্ভব। ২০১৮ সালে প্রকাশিত নেচার ও জার্নাল অফ দ্য আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি-এর গবেষণাপত্রে সমুদ্র থেকে সোনা আহরণের জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তিগত প্রস্তাব উঠে আসে। কিন্তু এসব পদ্ধতির কার্যকারিতা এখনো বিতর্কিত এবং বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারযোগ্য হয়নি।

সমুদ্রের গভীরে সোনা জমা হওয়ার পেছনে রয়েছে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। ভূমিক্ষয়ের ফলে শিলা ও খনিজে থাকা সোনা ধীরে ধীরে নদী-নালা বেয়ে সমুদ্রে পৌঁছায়। টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট বা সমুদ্রতলের ফাটল দিয়েও সোনা-সমৃদ্ধ উত্তপ্ত তরল নির্গত হয়ে সমুদ্রের জলে মিশে যায়।

এছাড়া ঝোড়ো বাতাস ভূমি থেকে সোনার ধুলিকণাও সমুদ্রে বয়ে আনে। এসব কারণে হাজার হাজার বছরের ব্যবধানে গড়ে উঠেছে সোনার বিশাল ভান্ডার।

বিশেষত ভূমধ্যসাগর, আটলান্টিক ও উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে এই সঞ্চয় বেশি পরিমাণে রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বর্তমান দরে এক টন সোনার মূল্য প্রায় ১০ কোটি ৬০ লক্ষ ডলার। সে হিসাবে, যদি সমুদ্রে আসলেই ২০ কোটি টন সোনা থাকে, তবে এর মোট বাজারমূল্য দাঁড়াতে পারে প্রায় ২১৩০ লক্ষ কোটি ডলার, যা বৈশ্বিক অর্থনীতির তুলনায় বহুগুণ বেশি।

তবে প্রযুক্তিগত বাধা ও উচ্চ ব্যয়ের কারণে বাস্তবে সমুদ্র থেকে সোনা আহরণ এখনো অসম্ভব প্রায়। অতীতে ১৯৪১ সালে প্রস্তাবিত এক তড়িৎ-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় দেখা গিয়েছিল, খরচ সোনার মূল্যের পাঁচ গুণ বেশি পড়ে।

২০১৮ সালে নতুন একটি গবেষণায় স্পঞ্জের মতো সোনা শোষণ করতে সক্ষম উপাদানের প্রস্তাব দেওয়া হয়, যা কয়েক মিনিটেই সামান্য পরিমাণ সোনা সংগ্রহ করতে পারে। তবু বৃহৎ পরিসরে ব্যবহারিক ও লাভজনকভাবে এ প্রযুক্তি প্রয়োগ করা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ।

গবেষকরা বলছেন, এক লিটার সমুদ্রপানিতে মেলে সোনার ১৩০০ কোটি ভাগের এক ভাগ। ফলে উত্তোলন খরচ ও প্রাপ্ত সোনার পরিমাণের অমিলের কারণে বাণিজ্যিকভাবে এটি এখনো কার্যকর নয়। অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা, একদিন হয়তো আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান বা উন্নত তড়িৎ-রাসায়নিক প্রযুক্তি দিয়ে এ স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে পারে।

তবে বিকল্প সম্ভাবনার কথাও তুলেছেন গবেষকেরা। তাঁদের মতে, মহাকাশের গ্রহাণুসমূহে প্ল্যাটিনাম, সোনা, তামা, লোহাসহ নানা ধাতুর বিশাল ভান্ডার রয়েছে। সেসব আহরণ করা গেলে তা সমুদ্র থেকে সোনা তোলার চেষ্টার তুলনায় অনেক বেশি লাভজনক হতে পারে।

প্রশ্ন হলো, সমুদ্রের সোনা কি কখনও বাস্তবে মানুষের হাতের নাগালে আসবে, নাকি তা কেবলই কল্পনার এক রূপকথা হয়ে থাকবে?

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন