শুক্রবার
৩১ অক্টোবর ২০২৫, ১৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শুক্রবার
৩১ অক্টোবর ২০২৫, ১৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

৫০ হাজারে নবজাতককে বিক্রি করে দিলেন মা-বাবা

এনপিবি ডেস্ক
প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৪০ এএম আপডেট : ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৪৫ এএম
expand
৫০ হাজারে নবজাতককে বিক্রি করে দিলেন মা-বাবা

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার বুড়িশ্বর ইউনিয়নে দারিদ্র্যের তাড়নায় সন্তান বিক্রির হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে।

স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, ভিক্ষাবৃত্তি আর দিনমজুরির আয়ে চলা লালন মিয়া ও তার স্ত্রী মারুফা আক্তার (৩৫) সম্প্রতি দুই সন্তানকে অন্যের কাছে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

মারুফা-লালনের সংসারে বিয়ের আট বছরে একে একে সাত সন্তানের জন্ম হয়। তাদের নিজস্ব বাড়ি কিংবা জমি নেই; লালনের বাবা জীবিত থাকতেই অভাবের কারণে বাড়ি বিক্রি করতে বাধ্য হন। বর্তমানে দম্পতি অন্যের জমিতে বানানো একটি জরাজীর্ণ ঘরে বসবাস করছেন।

গত সেপ্টেম্বরে সন্তান জন্মের ১৫ দিন পর মারুফা তার নবজাতককে ৫০ হাজার টাকায় অন্যের হাতে তুলে দেন। এর আগেও তারা আরেকটি সন্তানকে ৪৫ হাজার টাকায় দিয়েছেন।

সংবাদকর্মীরা সরেজমিন গেলে দেখা যায়, দরিদ্র পরিবারটি অন্যের জমিতে বানানো খড়ের ছাউনির ঘরে বাস করছে। ঘরে দরজা নেই, নেই কোনো আসবাবপত্র। সদ্য সন্তান প্রসব করা মারুফা এক কোণে বসে আছেন; চারপাশে পাঁচটি শিশু মাটিতে বসে ভাত আর সেদ্ধ লাউ খাচ্ছে। দেখে মনে হয়, তারা অনেক দিন ভালো খাবার পায়নি।

সন্তান বিক্রির কারণ জানতে চাইলে মারুফা বলেন, “আমাদের কেউ নেই। অভাবে পড়লেই মানুষ গালি দেয়, ধাক্কা দেয়। বাচ্চাদের মুখে দুধ তোলার সামর্থ্য নেই, বিছানাও নেই, মাটিতে ঘুমাই। বুকের ভেতরে আগুন জ্বলে—কিছু করার নেই। নিজের সন্তান অন্যের হাতে তুলে দিয়েছি, আর মানুষ নানা কথা বলে। কিন্তু আমাদের খোঁজ নিতে কেউ আসে না।”

দম্পতির ফুফু জাহানারা বেগম জানান, “ওরা ভিক্ষা করে সংসার চালায়। নবজাতক জন্মের পর থেকেই অসুস্থ ছিল। চিকিৎসার সামর্থ্য না থাকায় তারা সন্তানকে দিতে বাধ্য হয়েছে।” লালন মিয়া বলেন, “বৌ আর নবজাতককে নিয়ে আমরা বিপদে পড়েছিলাম। বৌডা খুব অসুস্থ হয়ে যায় আর বাচ্চাটাও মরে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। ঘরে না খেয়ে, চিকিৎসা ছাড়াই যদি মরে যায়—তাই বিক্রি করতে হলো। কাগজপত্র করেই দিয়েছি, কাগজ ছাড়া কেউ নিতে চায় না।”

স্থানীয় বাসিন্দা নূরুন্নাহার বেগম বলেন, “মারুফার প্রসব বেদনা ওঠার সময় আমি ছিলাম। জন্মের পর থেকে বাচ্চাটা নানা রোগে ভুগছিল। আগের পাঁচটি সন্তানের খরচই তারা চালাতে পারে না; নতুন শিশুর চিকিৎসা কেমন করে করবে?”

বুড়িশ্বর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. ইকবাল চৌধুরী জানান, বিষয়টি আগে জানা ছিল না; খোঁজ নিচ্ছেন।

নাসিরনগর থানার ওসি মাকছুদ আহাম্মদ বলেন, তিনি সদ্য বদলি হয়ে এসেছেন; খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহীনা নাসরিন বলেন, “এটি খুবই দুঃখজনক। সরকারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে শুরু করে বিভিন্ন এনজিও যদি সচেতনভাবে কাজ করত তাহলে জন্মহার নিয়ন্ত্রণে আনা যেত। তারপরও পরিবারটিকে আর্থিক সহায়তা ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. হাফিজ উদ্দীন ভূইয়া বলেন, “দারিদ্র্য আগে যেমন ছিল, এখনো আছে; কিন্তু বস্তুবাদী সমাজব্যবস্থার কারণে পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে। আগে এমন ঘটনা শোনা যেত না, এখন নিয়মিতই ঘটছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন দপ্তর যদি দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করত, এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ করা যেত।”

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন