

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


কক্সবাজারের চকরিয়া ও বান্দরবানের লামা সীমান্তবর্তী বিশাল পাহাড়ি অঞ্চলে বছরের পর বছর ধরে চলছে অবৈধ বালু উত্তোলনের মহোৎসব। পাগলির ছড়ার শেষ প্রান্তের পূর্ব পাশ, রংমহলের সোজা পূর্ব দিক, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড, বগাছড়ি পাহাড়- এসব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলতে থাকে শক্তিশালী মেশিনের গর্জন।
স্থানীয়দের দাবি- সরকারি নিয়ম-নীতি অমান্য করে পরিচালিত এই বালু কারবারে প্রতিদিন লেনদেন হয় লাখ লাখ টাকা। মাস শেষে যার পরিমাণ দাঁড়ায় কয়েক কোটি টাকায়।
ডুলাহাজারার রংমহল এলাকার বাসিন্দা সৈয়দ আহমদের ছেলে জয়নাল আবেদীন ভুট্টো এই পুরো নেটওয়ার্কের নেতৃত্বে আছেন বলে জানিয়েছেন অন্তত সাতজন স্থানীয় বাসিন্দা। ভুট্টোর নির্দেশেই পাহাড়ি ছড়ার বিভিন্ন স্থানে বসানো হয় বালু উত্তোলনের ড্রেজার-মেশিন।
চক্রটির কার্যক্রম এতটাই সংগঠিত যে, মেশিন অপারেটর, পাহারা দল, পরিবহনকারী এবং স্টক পয়েন্ট- সবই পরিচালিত হয় সামরিক কৌশলগত নিপুণতায়। ভোরের অন্ধকারে মেশিন চালু হয়, আর রাত নামার পর ট্রাক-ডাম্পারের দীর্ঘ সারি পাহাড়ি গ্রাম ছাড়িয়ে চলে যায় বিভিন্ন লোড-আনলোড পয়েন্টে।
শুধু তাই নয়, অবৈধ বালু কারবারের কারণে এলাকায় বাড়ছে সংকট। ভারী ডাম্পার-ট্রাক চলাচলে গ্রামের সড়কগুলো ভেঙেচুরে যাচ্ছে, ধুলাবালির কারণে শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি, চোখের রোগে ভুগছেন গ্রামবাসী। প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা।
স্থানীয় এক শিক্ষক বলেন, এখানে কারো প্রতিবাদ করার সাহস নেই। যারা চিৎকার করে, তারা পরদিন বাড়ি থেকে বের হতে ভয় পায়। কারণ চক্রটির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আছে প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহল আর অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।
স্থানীয়দের মতে, চকরিয়া ও লামা উপজেলার কিছু অসাধু কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত মাসোহারা নিচ্ছেন। তাই অভিযান হয় দেখানোর জন্য, বাস্তবে ধরা পড়ে শুধু শ্রমিক বা ড্রেজারের লোহার পাইপ। মূল হোতারা আগেভাগেই পেয়ে যান খবর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রাজনৈতিক নেতা বলেন, প্রশাসন মাসে মাসে টাকা পায়। তাই তারা চায় না এই ব্যবসা বন্ধ হোক। তারা অভিযান চালায়, ছবি তোলে- কিন্তু পরদিনই সব আগের মতো।
পরিবেশবিদদের ভাষ্য, নিষিদ্ধ এলাকায় বালু উত্তোলনের ফলে তিন ধরনের ভয়াবহ ক্ষতি ইতোমধ্যে স্পষ্ট। পাহাড় ধসের ঝুঁকি চরমে- পাহাড়ের পেট কেটে বালু তোলায় ঢাল অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে; বিপন্ন হচ্ছে নিচের বসতবাড়ি, কৃষিজমি ও গ্রাম্য সড়ক। জলধারা শুকিয়ে যাচ্ছে- ছড়ার স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় মিঠাপানির মজুত কমছে। বনাঞ্চল ও প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস- মাটি সরে যাওয়ায় প্রাণীর আবাসস্থল ভেঙে পড়ছে, নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র।
কক্সবাজারের পরিবেশ নিয়ে কাজ করা এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন, যেভাবে ছড়ার পেট কেটে বালু তোলা হচ্ছে, এতে কয়েক বছরের মধ্যেই পুরো জলাধার শুকিয়ে যাবে। পাহাড় অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। পরে হয়তো আর কিছুই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না।
আয়ুব আলী নামের এক বৃদ্ধ কৃষক বলেন, আগে ছড়ার পানিতে সেচ নিতাম। এখন ছড়াই শুকিয়ে গেছে। জমি বসে যাচ্ছে। প্রতিবাদ করলে উল্টো হুমকি দেয়।
তথ্য বলছে, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এবং বালু-মাটি উত্তোলন, পরিবহন ও মজুত নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১০- দুটোতেই স্পষ্ট বলা আছে: স্রোতধারা, পাহাড় ও বনাঞ্চল থেকে বালু উত্তোলন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমন অপরাধে রয়েছে জরিমানা, কারাদণ্ড ও বাজেয়াপ্তকরণ- কিন্তু চক্রটির বিরুদ্ধে এতদিন কার্যকর কোনো ব্যবস্থা দেখা যায়নি।
জয়নাল আবেদীন ভুট্টো প্রথমে অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরে বলেন, চকরিয়া অঞ্চলে বালু তুলছি না, সব লামা হিল এলাকার মধ্যে। ডুলাহাজারায় শুধু স্টক করি। আর আমি একা না- সবাইকে ম্যানেজ করেই করি।
লামা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রুবায়েত আহমেদ বলেন, কিছুদিন আগে অভিযান চালিয়ে একজনকে আটক করেছি, বালু জব্দ করেছি। অফিসের কেউ মাসোহারা নেয় না। আমরা যাই, কিন্তু তারা আগাম খবর পেয়ে মেশিন বন্ধ করে দেয়।
চকরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রুপায়ন দেব জানান, ট্রাকসহ বালুর স্তূপ জব্দ করে নিলামে দিয়েছি। শুনছি আবার নতুনভাবে লামা সীমান্ত দিয়ে বালু এনে স্টক করছে। শিগগির আবার অভিযান হবে।
স্থানীয়দের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই পুরো অঞ্চল পরিবেশগতভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে।
ছড়া শুকিয়ে যাবে, পাহাড় বসে যাবে, কৃষিজমি অনুপযোগী হবে- আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য থাকবে শুধু ধ্বংসস্তূপ
মন্তব্য করুন