রবিবার
০৯ নভেম্বর ২০২৫, ২৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
রবিবার
০৯ নভেম্বর ২০২৫, ২৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

২৭ বছর বিনা বেতনে শিক্ষকতা, অবসরে গিয়ে নাইটগার্ড

পঞ্চগড় প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১০:১৩ এএম
মো. তোহিদুল ইসলাম (৭৩)
expand
মো. তোহিদুল ইসলাম (৭৩)

কাগজে-কলমে পদবি ছিল অফিস সহকারী, কিন্তু বাস্তবে ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। জীবনের টানা ২৭ বছর বিনা বেতনে শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছেন তিনি। অবসরে গিয়েও পাননি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা। এখন রাত জেগে বাজার পাহারা দিয়ে চলে তার সংসার।

তিনি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার টোকরাভাষা ইসলামিয়া একরামিয়া মহিলা দাখিল মাদরাসার পরিচিত মুখ মো. তোহিদুল ইসলাম (৭৩)। সবার কাছে যিনি পরিচিত 'সোনা মাস্টার' নামে। তোহিদুল ইসলাম দেবীগঞ্জ উপজেলার চিলাহাটি ইউনিয়নের টোকরাভাষা এলাকার মৃত তসির উদ্দীনের ছেলে।

জানা যায়, ১৯৮৭ সালে টোকরাভাষা ইসলামিয়া একরামিয়া মাদরাসার ইবতেদায়ি শাখায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। পরবর্তীতে ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠানটি দাখিল শাখার অনুমতি পেলে অফিস সহকারীর পদে যোগ দেন। তবে প্রশাসনিক কাজের পাশাপাশি নিয়মিত ক্লাসও নিতেন তিনি। প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে।

মাদরাসাটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় দীর্ঘ ২৭ বছর কোনো বেতন পাননি তোহিদুল ইসলাম। ২০১৪ সালে বয়সজনিত কারণে অবসরে যেতে হয় তাকে। অবসরের পরও কোনো ভাতা বা সুবিধা পাননি। বর্তমানে তিনি স্থানীয় টোকরাভাষা বাজারে নাইটগার্ড হিসেবে কাজ করেন। প্রতিদিনের আয় মাত্র ১৫০ টাকা যা দিয়ে কোনোমতে চলে সংসার।

তোহিদুল ইসলাম বলেন,জীবনের সোনালি সময়টা মাদরাসার জন্য দিয়েছি। কোনো বেতন পাইনি, অবসরে গিয়েও কিছু পেলাম না। এখন রাত জেগে বাজার পাহারা দিয়ে সংসার চালাই।

মাদরাসা সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৬ সালে ইবতেদায়ী শাখা দিয়ে যাত্রা শুরু হয় টোকরাভাষা ইসলামিয়া একরামিয়া মহিলা দাখিল মাদরাসার। বর্তমানে এখানে প্রায় ১৫০ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। প্রতিবছর ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেয়। শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ১৮ জন, তাদের সবার জীবনই অনিশ্চয়তায় ঘেরা।

বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের কাছে সোনা মাস্টার এখনো প্রিয় শিক্ষক। মাদ্রাসাটির ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী জান্নাতুন বলেন,স্যার অবসরে গিয়েও এখনও মাদরাসায় এসে ক্লাস নেন। তিনি শুধু শিক্ষক নন, অভিভাবকের মতো আমাদের যত্ন নেন।

সাবেক শিক্ষার্থী আয়শা সিদ্দীকা বলেন, আমাদের এলাকায় যারা একটু ভালো জায়গায় গেছে, সবার পেছনে সোনা স্যারের হাত আছে। অথচ আজ তিনি নাইটগার্ডের কাজ করছেন।এটা আমাদের জন্য কষ্টের ও লজ্জার।

স্থানীয় অভিভাবক আনছারুল বলেন,এত বছর বিনা বেতনে একজন মানুষ কীভাবে শিক্ষাদান চালিয়ে গেলেন, সেটাই বিস্ময়ের বিষয়। সরকার যদি দ্রুত এই মাদরাসাটি এমপিওভুক্ত না করে, তাহলে শিক্ষক-কর্মচারীদের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে পড়বে।

টোকরাভাষা বাজার বণিক সমিতির সভাপতি কামাল মোস্তাহারুল হাসান নয়ন বলেন,সোনা মাস্টার বয়স হলেও খুব দায়িত্বশীল। আমরা বণিক সমিতির পক্ষ থেকে তার পাশে থাকার চেষ্টা করছি। সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন যদি এমন মানুষের প্রতি একটু নজর দেয়, তাহলে সমাজ উপকৃত হবে।”

মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের মাদরাসাটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দীর্ঘদিন ধরে আমরা সরকারের কাছে আবেদন করে আসছি, কিন্তু এখনও আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না।

দেবীগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) সাইফুল ইসলাম বলেন, টোকরাভাষা ইসলামিয়া একরামিয়া মহিলা দাখিল মাদরাসাটি দীর্ঘদিন ধরে এমপিওবহির্ভূত। সোনা মাস্টার বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন। এটা সত্যিই প্রশংসনীয়।

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন