

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


তাইওয়ান প্রণালীর নীরব জলরাশির নিচে এখন ঘনীভূত হচ্ছে এক নতুন ধরনের উত্তেজনা—যা না সরাসরি যুদ্ধ, না পুরোপুরি শান্তি। এই অদৃশ্য সংঘাতের চিত্র উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস)–এর সাম্প্রতিক এক গবেষণায়।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন এখন ব্যাপকভাবে বেসামরিক মাছ ধরার নৌকা ব্যবহার করছে সামরিক কৌশলের অংশ হিসেবে।
এই ধরণের কর্মকাণ্ডকে বলা হয় গ্রে-জোন অপারেশনস (Gray-zone operations)—যা সরাসরি যুদ্ধ না হলেও যুদ্ধের ছায়া তৈরি করে প্রতিপক্ষের ওপর মনস্তাত্ত্বিক ও কৌশলগত চাপ সৃষ্টি করে।
সিএসআইএস তাদের গবেষণায় ৩১৫টি চীনা পতাকাবাহী নৌযানের জিপিএস ও এআইএস সংকেত বিশ্লেষণ করেছে।
এতে দেখা গেছে, ১২৮ থেকে ২০৯টি জাহাজ সন্দেহজনক গতিবিধি করছে। তাদের অধিকাংশই ঘুরছে সামরিক প্রশিক্ষণ এলাকার কাছে, অথচ প্রকৃত মাছ ধরার অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি খুবই সীমিত।
অবাক করার মতো তথ্য হলো—দুই শতাধিক নৌযান নিয়মিত এআইএস সংকেত বন্ধ রাখছে, যা আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক আইন লঙ্ঘনের শামিল।
এমনকি একটি জাহাজ এক বছরের মধ্যে ১১টি ভিন্ন পরিচয় নম্বর ব্যবহার করেছে এবং ১,৩০০ বারের বেশি নিজের সংকেত বদলেছে, যেন নিজস্ব গতিপথই গোপন রাখা যায়।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, এসব নৌযানের বড় অংশ চীনের মারিটাইম মিলিশিয়ার অধীনে পরিচালিত। নামমাত্র বেসামরিক হলেও তারা আসলে পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)-র অনানুষ্ঠানিক বাহিনী হিসেবে কাজ করছে।
এসব নৌযান বাণিজ্যিক জাহাজের আড়ালে চলাচল করলেও মূল উদ্দেশ্য—তাইওয়ান ও আশপাশের অঞ্চলে নজরদারি, ভয় প্রদর্শন ও চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা।
Joint Sword–2024A ও 2024B মহড়ার সময়ও তাদের অস্বাভাবিক গতিবিধি ধরা পড়ে, যা এই সন্দেহ আরও জোরালো করে।
বিশ্লেষকদের মতে, চীনের এই কৌশলের মূল উদ্দেশ্য হলো তাইওয়ানের ওপর ক্রমাগত মনস্তাত্ত্বিক চাপ বজায় রাখা।
বেইজিং সরাসরি যুদ্ধ চায় না, কারণ এতে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া আসতে পারে। তাই তারা এমন এক মাঝামাঝি পদ্ধতি বেছে নিয়েছে যেখানে ভয়, বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব নৌযানের অনেকগুলোর মালিকানা শেল কোম্পানির নামে নিবন্ধিত, যেগুলোর পেছনে চীনের সামরিক বা সরকারি তহবিল জড়িত থাকতে পারে।
তাই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, যেন তারা এসব কোম্পানির আসল মালিক, বীমাকারী ও অপারেটরদের ট্র্যাক করে কালো তালিকাভুক্ত করে এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে চীনের “অস্বীকারযোগ্যতা” (deniability) নীতি দুর্বল হবে বলে মনে করছে সিএসআইএস।
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত এক বছরে চীনের তিন হাজারের বেশি যুদ্ধবিমান তাইওয়ান প্রণালীর মধ্যরেখা অতিক্রম করেছে, আর প্রায় দুই হাজার নৌযান প্রবেশ করেছে তাদের একচেটিয়া অর্থনৈতিক এলাকায়।
এই ক্রমবর্ধমান অনুপ্রবেশ ঠেকাতে তাইওয়ান উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মানববিহীন নজরদারি যান তৈরি করছে, যেখানে থাকবে অপটিক্যাল ও ইনফ্রারেড সেন্সরসহ উন্নত রাডার সিস্টেম। লক্ষ্য একটাই—চীনের প্রতিটি গোপন চলাচল শনাক্ত করে প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আজকের বিশ্বে যুদ্ধের সংজ্ঞাই বদলে গেছে। একসময় সংঘাত মানে ছিল বন্দুকের গর্জন, আর এখন তা নীরব সমুদ্র, তথ্য নেটওয়ার্ক এবং অর্থনৈতিক রুটে ছড়ানো কৌশল।
‘মাছ ধরার নৌকা’-র ছদ্মবেশে চীন এখন কার্যত তৈরি করছে এক নতুন শীতল যুদ্ধের মঞ্চ, যেখানে প্রতিটি তরঙ্গই রাজনৈতিক বার্তা বহন করছে, প্রতিটি নৌচলাচলই সম্ভাব্য সংঘাতের পূর্বাভাস।
প্রশ্ন শুধু একটাই—এই ‘নিঃশব্দ যুদ্ধ’ কোথায় গিয়ে থামবে? আজ তাইওয়ান প্রণালী, কাল দক্ষিণ চীন সাগর, আর ভবিষ্যতে হয়তো বঙ্গোপসাগর—যেখানে সমুদ্রের গভীরতাই হয়ে উঠবে নতুন ক্ষমতার মানদণ্ড।
মন্তব্য করুন
