সোমবার
০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৯ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সোমবার
০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৯ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

লোহিত সাগরের তীরবর্তী দেশ, গৃহযুদ্ধে ‘ভূতুড়ে শহরে’ পরিণতি

এনপিবি ডেস্ক
প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৪০ পিএম
লোহিত সাগর তীরবর্তী উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দেশ সুদান।
expand
লোহিত সাগর তীরবর্তী উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দেশ সুদান।

দুই সেনাপতির ঝগড়ায় রক্তাক্ত গোটা দেশ! সংশ্লিষ্ট বিবাদকে কেন্দ্র করে এক ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধে জড়িয়েছে সে দেশের সাধারণ মানুষ। এ পরিস্থিতিতে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’-র মতো রণাঙ্গনে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে সামরিক ড্রোনের। চালকহীন বিমান হামলায় অধিকাংশ সময় প্রাণ যাচ্ছে নিরীহ মানুষের। এই গণহত্যার সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে তীব্র খাদ্যসঙ্কট। ফলে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। ঘরোয়া কোন্দল তাঁদের সামনে ‘নরকের দরজা’ খুলে দিয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না।

লোহিত সাগর তীরবর্তী উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দেশ সুদান। ২০২৩ সালে ১৫ এপ্রিল মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়ায় সেখানকার সামরিক সরকারের দুই গোষ্ঠী। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল গৃহযুদ্ধ। আড়াই বছর পেরিয়ে লড়াই থামার কোনও নাম-গন্ধ নেই। উল্টে দিনকে দিন বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। এ রক্তক্ষয়ী ঘরোয়া কোন্দলের যুদ্ধকারী দুই পক্ষ হল সুদানি সশস্ত্র বাহিনী (সুদানিজ আর্মড ফোর্স বা এসএএফ) এবং র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)।

বিবদমান দুই গোষ্ঠীর প্রথমটির নেতৃত্বে রয়েছেন জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান। এসএএফ-কে সুদানের সরকারি সেনা বলা যেতে পারে। অন্য দিকে আরএসএফ হল সেখানকার একটি আধা সামরিক বাহিনী। তাদের অবিসংবাদি নেতা হলেন জেনারেল মহম্মদ হামদান দাগালো। চলতি বছরের ১১ অক্টোবর তাঁর নির্দেশেই উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দেশটির দারফুরের এল ফাশার এলাকায় অবস্থিত ওমদুরমান ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ড্রোনহামলা চালায় ‘বিদ্রোহী’ আধা সেনার সদস্যেরা।

স্থানীয় গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে আশ্রয় নেন গৃহযুদ্ধের কারণে বাস্তুচ্যুত বহু মানুষ। আচমকাই সেখানে ড্রোনের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটায় ক্যাম্পটির একাংশ ভেঙে পড়ে।

এতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ২২ মহিলা ও ১৭ শিশু-সহ কমপক্ষে ৫৭ জনের। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, পাইলটবিহীন বিমান থেকে আক্রমণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কামান থেকে শুরু হয় ভারী গোলাবর্ষণ। ফলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রায় ধ্বংস হয়ে যায় ওই যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর।

গত ১১ অক্টোবরই প্রথম বার নয়। সাম্প্রতিক সময়ে সুদানের গৃহযুদ্ধকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে ড্রোন। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের কথায়, সংশ্লিষ্ট সংঘর্ষের গতিপ্রকৃতি পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণে পাইলটবিহীন বিমানের বহুল ব্যবহার। সংঘাতের গোড়ার দিকে কেবলমাত্র সুদানি সশস্ত্র বাহিনীর উপর নজরদারি করতে ড্রোন ব্যবহার করছিল ‘বিদ্রোহী’ আধা সেনা। উল্টো দিকে তাঁদের কোণঠাসা করতে হামলাকারী উড়ুক্কু যান ছিল সরকারি এসএএফের হাতে।

কিন্তু, পরবর্তী সময়ে বিস্ফোরকবোঝাই ড্রোন চলে আসে আরএসএফের অস্ত্রাগারেও। ফলে সরকারি বাহিনীর উপর চোরাগোপ্তা আক্রমণের ঝাঁজ বাড়িয়ে দেশের একটা বিশাল ভূখণ্ড দখলে নিতে সক্ষম হয় তারা।

স্থানীয় গণমাধ্যমগুলি জানিয়েছে, গৃহযুদ্ধের গোড়ার দিকে লড়াই ছিল কেবলমাত্র স্থলভিত্তিক। ফলে মূলত ব্যবহার হচ্ছিল কামান, মর্টার, সাঁজোয়া গাড়ি এবং ল্যান্ডমাইন। ফলে অবরোধ তৈরি করে শহরে ঢুকে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো ‘বিদ্রোহী’দের পক্ষে মোটেই সহজ ছিল না।

কিন্তু দু’পক্ষের হাতেই ড্রোন চলে আসার পর পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে শুরু করে। বর্তমানে আরএসএফের যোদ্ধারা অনেকটা দূরে বসে নির্ভুল ভাবে হামলা চালাতে পারছে। ফলে হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে আবাসন বা সরকারি-বেসরকারি দফতর, কোনও কিছুকেই নিশানা করতে ছাড়ছে না তারা। পাইলটবিহীন বিমানগুলির জন্যই সুদানের বিস্তীর্ণ এলাকায় শুরু হয়েছে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ আর মৃত্যুমিছিল।

ড্রোনহামলা আটকাতে ভারত-সহ বিশ্বের প্রায় সমস্ত উন্নত সামরিক বাহিনীর হাতে আছে অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (পড়ুন এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম)। কিন্তু সুদানের সরকারি ফৌজের হাতে এই ধরনের কোনও বর্ম নেই। ফলে এলাকার পর এলাকায় পাইলটবিহীন বিমানে আক্রমণ শানিয়ে আতঙ্ক তৈরির সুযোগ পাচ্ছে ‘বিদ্রোহী’ আধা সেনা। কিছু দিন আগে এ বিষয়ে মুখ খোলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু (ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজ়েশন)। হাসপাতালে ড্রোন হামলার কড়া নিন্দা করেছে এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান।

এ বছরের জানুয়ারিতে এল ফাশার এলাকার একটি হাসপাতালে ড্রোনহামলা চালায় আরএসএফ। ফলে সেখানকার কর্মী, রোগী এবং তাঁদের আত্মীয় মিলিয়ে প্রাণ হারান অন্তত ৭০ জন। পাশাপাশি, ‘বিদ্রোহী’দের ছোড়া মানববিহীন উড়ুক্কু যানে বিকল হয়ে যায় সুদানের বিদ্যুতের গ্রিড ও সাবস্টেশন। ফলে সরকারি ফৌজ নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলি বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া একটি বাঁধেও ড্রোনহামলা চালিয়েছে জেনারেল দাগালোর লড়াকু যোদ্ধারা।

হাসপাতালে বিস্ফোরক ড্রোন আছড়ে পড়ায় বিকল হয়েছে রেফ্রিজ়ারেটর। ফলে নষ্ট হচ্ছে ওষুধ এবং খাবার। এতে বাস্তুচ্যুত লক্ষ লক্ষ সুদানবাসীর দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। গত মে মাসে পাইলটবিহীন বিমানহানায় কাসালা এবং পোর্ট সুদানের বিমানবন্দর এবং জ্বালানি ডিপোয় আগুন ধরে যায়। রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্টে বলা হয়েছে, নমাজের সময় ড্রোনে মসজিদগুলিকে নিশানা করছে ‘বিদ্রোহী’রা। এর জন্যেই শিশুমৃত্যুর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সবচেয়ে খারাপ অবস্থা অবরুদ্ধ শহর আল-ফাশারের। ড্রোনহামলা গোটা এলাকাটিকে ‘ভূতের শহর’-এ পরিণত করেছে। একসময়ে সেখানকার বাসিন্দাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ লক্ষ। সেটি বর্তমানে অর্ধেকের বেশি কমে গিয়েছে। ‘বিদ্রোহী’দের মানববিহীন উড়ুক্কু যান তছনছ করে দিয়েছে বাজার, স্কুল এবং হাসপাতাল। ফলে অনেকেই বাড়ির চারপাশে কয়েক ফুট গভীর কাঁচা বাঙ্কার তৈরি করেছেন। এ ছাড়াও রয়েছে ৫৭ কিলোমিটার লম্বা মাটির পাঁচিল। এ ভাবেই আরএসএফের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন সেখানকার বাসিন্দারা।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, বর্তমানে পশুখাদ্য এবং আবর্জনা খেয়ে বেঁচে আছে আল-ফাশারবাসী। ড্রোনের জন্যেই বিদ্যুৎ এবং পানীয় জলের পরিষেবা ধ্বংস করে একের পর এক শহরকে পঙ্গু করে দিচ্ছে ‘বিদ্রোহী’ আধা সেনা। ফলে গৃহযুদ্ধের মধ্যেই অত্যাধুনিক পাইলটবিহীন বিমান এবং ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে এসএএফ। দ্বিতীয়টি একটি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম)। আফ্রিকার দেশটিতে এগুলির অনুপ্রবেশ সংঘর্ষকে আরও জটিল করবে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।

সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ আবার জানিয়েছে, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের হাতে যে ধরনের ড্রোন রয়েছে সেগুলিই ব্যবহার করছে আরএসএফ। পাশাপাশি চিনা এয়ার ডিফেন্স এফকে-২০০০ ব্যবহার করছে তারা। মার্কিন গণমাধ্যমটির অনুমান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, তুরস্ক এবং ইরানের মতো আঞ্চলিক মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে চোরাপথে একের পর এক মারাত্মক হাতিয়ার পাচ্ছে আরএসএফ। যদিও সংশ্লিষ্ট দেশগুলি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের কথায়, গৃহযুদ্ধের গোড়ার দিকে আকাশপথে আক্রমণের ভয় ছিল না। কিন্তু, গত কয়েক মাসে সেই ছবি পাল্টে গিয়েছে। বর্তমানে মাঝেমধ্যেই মাথার উপর ঘুরতে দেখা যায় ড্রোন। আগে হাসপাতাল বা স্কুলে আশ্রয় নেওয়াকে নিরাপদ বলে মনে করা হত। এখন সেখানেই সর্বাধিক বিস্ফোরক ঘটাচ্ছে মানববিহীন উড়ুক্কু যান। শহর জুড়ে সর্বত্রই মৃত্যুফাঁদ তৈরি হয়েছে বলা যেতে পারে।

গৃহযুদ্ধে ড্রোনের অনুপ্রবেশের পর একাধিক হাসপাতাল বন্ধ করেছে সুদানের সামরিক সরকার। তার মধ্যে রয়েছে ওবাইদ এবং রাজধানী খার্তুমের হাসপাতাল। আল-ফাশারের বাসিন্দাদের তো নিজেদেরই ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে মৃতদেহ উদ্ধার করতে হচ্ছে।

তবে এই নির্বিচারে আমজনতার মৃত্যুর দায় অবশ্য নিতে নারাজ ‘বিদ্রোহী’ আরএসএফ। তাদের যুক্তি, শহরে ড্রোনহামলা চালাচ্ছে সরকারি সশস্ত্র বাহিনী। উল্টো দিকে আরএসএফ-এর দিকে আঙুল তুলছেন এসএএফ কমান্ডারেরা। হামলার সময় সুনির্দিষ্ট ভাবে ড্রোন চিহ্নিত করা কঠিন হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট)।

সূত্রের খবর, যুদ্ধাপরাধের তদন্তে কৃত্রিম উপগ্রহের পাঠানো ছবি, ফরেন্সিক বিশ্লেষক এবং ওপেন সোর্স গোয়েন্দা তথ্য ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও এর মাধ্যমে অভিযুক্তদের আদৌ সাজা হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আফ্রিকার দেশটির প্রায় আড়াই কোটি মানুষ বর্তমানে দু’বেলা ঠিকমতো খেতে পাচ্ছেন না বলা হয়েছে।

১৯৫৬ সালে স্বাধীনতা লাভের পর কখনওই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেখেনি সুদান। আফ্রিকার দেশটিতে প্রায় ২০ বার সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছে। ২০২১ সালে সুদানি সশস্ত্র বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সকে ফৌজের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। সেখান থেকেই বিবাদের সূত্রপাত। বর্তমানে গৃহযুদ্ধে স্থানীয় কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী জড়িয়ে পড়েছে বলে জানা গিয়েছে।

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন