

পোস্টে শামারুহ মির্জা লেখেন, ইদানিং ফেসবুক খুললেই এক শিক্ষিকার রিল! সুন্দরী শিক্ষিকা! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের! বাহ! বিউটি উইথ ট্যালেন্ট! আমি নিজে ডিইউতে পড়েছি ও পড়িয়েছি!
প্রথমে ভালোই লাগলো! কিন্তু আমি খেয়াল করলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত যা রিল আসে, তার মেজরিটি হচ্ছে এই শিক্ষিকা কীভাবে হাঁটছেন, হাসছেন, আঙুল তুলে শাসন করছেন, ক্যান্সার উচ্চারণ করতে ভয় পাচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি!
অথবা রিল আসছে, ক্যাম্পাস এ ভবঘুরে উচ্ছেদ, ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে আলোচনা, বিভিন্ন স্টলে বিখ্যাত কুখ্যাত ব্যক্তিদের বিশাল বিশাল ব্যানার!
না, এসব একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়! একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা, দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণা, কেন মানুষ ছিন্নমূল হয়, তা নিয়ে গবেষণা, পিয়ার রিভিউয়েড জার্নালে পাবলিকেশন, এম্পথি কেন একজন নেতার গুরুত্ব পূর্ণ ট্রেইট হবে তা নিয়ে আলোচনা!
তিনি আরও লিখেছেন, ‘সমস্যা হচ্ছে যারা আজ এই রিলগুলো তৈরি করছেন কিংবা মিডিয়া তে ছাড়ছেন (এখানে এই শিক্ষিকার কোনও ভূমিকা নেই), তারা ডিইউ’র ক্ষতি করছে, ডিইউ যে নিম্নমানের বিশ্ববিদ্যালয় তা প্রমাণ করছেন। দুঃখজনক! কেমনে আমি এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিলের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাই!’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও সহকারী প্রক্টর শেহরীন আনিম ভূইয়া মোনামীকে নিয়ে চলা বিতর্কের বিষয়ে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কন্যা বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী ড. শামারুহ মির্জা।
পোস্টটি নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলে এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি।
আজ রবিবার (২ নভেম্বর) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে শামারুহ মির্জা লিখেছেন, ‘আমি ডিইউ এর নিম্নমানের কথা বলেছিলাম দুদিন আগে! আমি নিজে এর ছাত্রী এবং শিক্ষক ছিলাম!
তবু বলেছি, বিকজ এটা রিয়ালিটি! এটা নিয়ে প্রপার রিঅ্যাকশন হওয়া উচিৎ, এটা বেটার করতে কাজ করা! তা হয়নি! বরং এক শিক্ষিকা নিয়ে নোংরামি হলো! এবং আমার বিরুদ্ধে হলো আরেক ফ্রন্ট থেকে!’
তিনি বলেন, ‘আসলে আমরা মেধার মানে কোথায় যাচ্ছি, এটা আরেকটা প্রমাণ! সেদিন জানলাম একটি জেলার ছয়টি কলেজের একজনও এইচএসসিতে পাস করেনি! যাক! বাংলাদেশে নারী অধিকারের আন্দোলন ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত!
শেখ হাসিনা সংসদে খালেদা জিয়াকে নিয়ে ব্যক্তিগত ও অবমাননাকর মন্তব্য করেছিলেন। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা বীরাঙ্গনা শব্দটিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করে।’
এর মাধ্যমে একদিকে খালেদা জিয়াকে হেয় করা হয়েছিল, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের সেই নারীদের স্মৃতিকেও অসম্মান করা হয়েছিল উল্লেখ করে শামারুহ মির্জা বলেন, ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দের এ অপব্যবহার প্রমাণ করেছিল, আমরা জাতীয় ট্র্যাজেডিকেও রাজনীতির অস্ত্র বানাতে দ্বিধা করি না।
রাজনীতিতে নারীদের প্রতি আচরণে দ্বৈত মানদণ্ড আছে—একজন নারী নেত্রীকে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষায় অপমান করা গেলেও তেমন কোনো প্রতিবাদ ওঠে না। একজন পুরুষ নেতার ক্ষেত্রে এটা অকল্পনীয়।
‘প্রশ্ন হলো—এ ঘটনার পর নারীবাদী সংগঠনগুলো চুপ থাকল কেন? এ নীরবতা এক ধরনের নারীর প্রতি অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। নাগরিক সমাজ, নারী অধিকারকর্মী, এমনকি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করা গবেষকরাও মুখ খোলেননি। কেউ প্রতিবাদ করেননি। এই নীরবতা প্রমাণ করে, আমরা এখন ন্যায়বিচার ও মানবিকতার প্রশ্নেও রাজনৈতিক সুবিধা–অসুবিধা মেপে চলি’, যোগ করেন তিনি।
তার ভাষ্য, এ নীরবতা নাগরিক সমাজের ভয় ও আত্মসমর্পণ প্রকাশ করে, রাষ্ট্রের প্রতিশোধের ভয়, তহবিল হারানোর ভয়, কিংবা ‘বিরোধী’ তকমা পাওয়ার ভয়। কিন্তু যখন ভয়-নৈতিকতার জায়গা দখল করে, তখন সমাজ নিজের আত্মা হারায়।
বাংলাদেশের নারীবাদী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো সবসময় নারীর প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে এসেছে, বিশেষ করে যখন সেটা ধর্মীয় গোষ্ঠী বা গ্রামীণ সমাজ থেকে এসেছে। কিন্তু রাষ্ট্র যখন অন্যায় করে, বা প্রগতিশীল এলিট গোষ্ঠী যখন নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে, তখন এ আওয়াজ থেমে যায়।’
শামারুহ মির্জা বলেন, ‘খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে এ নীরবতা সবচেয়ে স্পষ্ট। তিনি যখন নারী বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন, সন্দেহজনক মামলায় কারাবন্দী হয়েছেন, বা চিকিৎসা না পেয়ে কষ্ট পেয়েছেন, তখন নারী অধিকার আন্দোলনের পক্ষ থেকে কোনো শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর ভূমিকা ঐতিহাসিক, কিন্তু feminist বা একাডেমিক আলোচনায় তাঁকে প্রায় অদৃশ্য রাখা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার feminist গবেষণাগুলো সাধারণত সে নারী নেত্রীদের নিয়েই কথা বলে, যারা উচ্চশিক্ষিত, উন্নয়নের ভাষায় পারদর্শী এবং উদার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। নাইলা কাবীর (২০০২) বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার নারীবাদ প্রায়শই সেই নারীদের প্রাধান্য দেয়, যারা ‘অধিকার ও উন্নয়নের ভাষায় সাবলীল’, অথচ যাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে আসে, তাদের উপেক্ষা করা হয়। খালেদা জিয়া সে শ্রেণির বাইরে, তাই তাঁকে প্রায়ই ‘অস্বস্তিকর নারী’ হিসেবে দেখা হয়েছে।
তার মতে, নারীবাদী সংগঠনগুলো তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি রাজনৈতিক নির্যাতন, কারাবাস, বা চরিত্রহননের সময়। এ সিলেক্টিভ সাপোর্ট দেখায় যে, নারীবাদী আন্দোলনেও রাজনৈতিক পক্ষপাত ও শ্রেণিগত দূরত্ব আছে। খালেদা জিয়ার উদাহরণ সেটাই দেখায়—একজন নারী যিনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নেতৃত্বের শীর্ষে উঠেছেন, অথচ feminist মহলে তাঁর নাম উচ্চারণই হয় না।
যেখানে ইন্দিরা গান্ধী বা বেনজির ভুট্টো নিয়ে অসংখ্য গবেষণা হয়েছে, সেখানে খালেদা জিয়া অপ্রাসঙ্গিক নারীবাদী আলোচনায় বলে মনে করেন শামারুহ মির্জা। তিনি বলেন, এ নীরবতা শুধু তাঁর প্রতি নয়, নারীবাদী আন্দোলনের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতিও আঘাত। আজকের বাস্তবতা হলো—বাংলাদেশে নারীবাদ অনেক সিলেক্টিভ। যখন রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক, তখন আওয়াজ তোলা হয়; আর যখন অস্বস্তিকর বা ঝুঁকিপূর্ণ, তখন চুপ থাকা হয়। এ নীরবতার মূল্য শুধু খালেদা জিয়ার নয়, এর খেসারত দিতে হবে ভবিষ্যতের নারী নেত্রীদেরও।
মন্তব্য করুন