শুক্রবার
২১ নভেম্বর ২০২৫, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শুক্রবার
২১ নভেম্বর ২০২৫, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পবিত্র কুরআনের নামের রহস্য

এনপিবি ডেস্ক
প্রকাশ : ২০ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৪৯ পিএম
সংগৃহীত ছবি
expand
সংগৃহীত ছবি

পবিত্র কুরআন মানবজাতির জন্য আল্লাহ তাআলার নাজিলকৃত সর্বশেষ গ্রন্থ। এটি শুধু একটি ধর্মীয় বিধানগ্রন্থ নয়; বরং মানব সভ্যতা, নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা ও জীবনদর্শনের পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা। মুসলিম সমাজ ছাড়াও বিশ্বের নানা ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ এ কিতাবকে ‘কুরআন’ নামেই জানে। এই নাম মানুষের দেওয়া নয়—আল্লাহ তাআলাই তাঁর কিতাবের নাম রেখেছেন ‘القرآن’। কুরআনে প্রায় পঞ্চাশবার এই নাম উল্লেখ এসেছে।

এ ছাড়াও কুরআনের আরও কিছু নাম ও বহু গুণবাচক উপাধি রয়েছে, যেগুলো এর বৈশিষ্ট্য, উদ্দেশ্য ও মহিমাকে সুন্দরভাবে তুলে ধরে। পাঠকদের অনুধাবনের সুবিধার্থে এখানে কুরআনের সেই নামসমূহ ও গুণাবলি সুশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপন করা হলো—যাতে কুরআনের মর্যাদা ও আধ্যাত্মিক গভীরতা আরো স্পষ্টভাবে হৃদয়ে ধারণ করা যায়।

কুরআনের প্রধান নামসমূহ (أسماء القرآن)

কুরআনের অনেক গুণাবলি রয়েছে, তবে ‘নাম’ হিসেবে আল্লাহ তাআলা যে শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন—তার সংখ্যা সীমিত। নিচে সেই আসল নামগুলো তুলে ধরা হলো—

১. القرآن (আল-কুরআন)

এটাই কিতাবটির প্রধান নাম। অর্থ—‘পাঠ’, ‘অবিরাম তিলাওয়াতযোগ্য গ্রন্থ’। আল্লাহ তাআলা একাধিক আয়াতে বলেন-

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَىٰ وَالْفُرْقَانِ

‘রমজান মাস—যে মাসে কুরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াত হিসেবে এবং সঠিক পথের সুস্পষ্ট প্রমাণসমূহ ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী হিসেবে।’ (সুরা আল-বাকারা: আয়াত ১৮৫)

قُلْ أَيُّ شَيْءٍ أَكْبَرُ شَهَادَةً ۖ قُلِ اللَّهُ شَهِيدٌ بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ وَأُوحِيَ إِلَيَّ هَٰذَا الْقُرْآنُ لِأُنذِرَكُم بِهِ

‘বল, সাক্ষ্যের দিক থেকে কোন জিনিস সবচেয়ে বড়?’ বল, ‘আল্লাহই আমার ও তোমাদের মাঝে সাক্ষী। আর এ কুরআন আমার প্রতি ওহি করা হয়েছে, যাতে আমি এর মাধ্যমে তোমাদেরকে সতর্ক করি।’ (সুরা আল-আন‘আম: আয়াত ১৯)

وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ

‘যখন কুরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন মনোযোগ দিয়ে শুনো এবং নীরব থাকো—যাতে তোমরা রহমত প্রাপ্ত হও।’ (সুরা আল-আ‘রাফ: আয়াত ২০৪)

২. الفرقان (আল-ফুরকান): ‘সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী’

এটাও কুরআনের প্রধান নামের একটি। অর্থ— ‘সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী’। আল্লাহ তাআলা এ নামে একটি সুরাই নাজিল করেছেন। এ সুরার প্রথম আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা ঘোষণা দেন-

تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَىٰ عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا

‘অপরিসীম বরকতময় তিনি, যিনি তার বান্দার ওপর ‘ফুরক্বান’ নাজিল করেছেন, যাতে তিনি সমগ্র মানবজাতির জন্য সতর্ককারী হন।’ (সুরা আল-ফুরকান: আয়াত ১)

৩. الكتاب (আল-কিতাব)

কুরআনকে الكتاب (আল-কিতাব)ও বলা হয়। এটিও কুরআনের প্রধান নামের একটি। অর্থ— ‘লিখিত গ্রন্থ’, ‘নির্ধারিত বিধানসমূহের সংকলন’। আল্লাহ তাআলা বলেন-الم ذَٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ

‘আলিফ-লাম-মীম। এই গ্রন্থ— এতে কোনো সন্দেহ নেই। এটি মুত্তাকীদের জন্য হিদায়াত।’ (সুরা আল-বাকারা: আয়াত ১–২)

৪. الذكر (আয-জিকর): ‘স্মরণ’, ‘উপদেশ’, ‘জাগরণের বার্তা’। আল্লাহ তাআলা বলেন—

إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ

‘নিশ্চয়ই আমরাই ‘জিকর’ নাজিল করেছি এবং নিশ্চয়ই আমরাই এটির রক্ষাকারী।’ (সুরা আল-হিজর: আয়াত ৯)

‘কুরআন’— এ নামটি তার তিলাওয়াতযোগ্যতা নির্দেশ করে; ‘ফুরকান’ তার ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়ের ক্ষমতা প্রকাশ করে; ‘কিতাব’ তার সংরক্ষণ, নীতি ও বিধির স্থায়িত্ব নির্দেশ করে; ‘জিকর’ তার স্মরণ ও হৃদয়ের জাগরণকে প্রতিফলিত করে।

যেসব শব্দ নাম নয় বরং বৈশিষ্ট্য (صفات)

‘এছাড়া আরও কিছু নাম আছে, যেগুলোকে কেউ কেউ কুরআনের নাম মনে করেছেন আবার কেউ কেউ এগুলোকে কুরআনের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করেছেন। কিন্তু সম্ভবত এগুলো মূলত কুরআনের বৈশিষ্ট্যই, নাম নয়। কুরআনের উল্লেখিত কিছু শব্দকে কেউ কেউ কুরআনের ‘নাম’ বলে মনে করেন, কিন্তু এগুলো আসলে কুরআনের নাম নয় বরং বৈশিষ্ট্য। যা তুলে ধরা হলো—

১. كلام الله — ‘আল্লাহর বাণী’

حَتّى يَسْمَعَ كَلَامَ اللَّهِ

‘যাতে সে আল্লাহর বাণী শুনতে পারে।’ (সুরা আত-তাওবা: আয়াত ৬)

২. التنزيل — ‘অবতীর্ণ গ্রন্থ’

وَإِنَّهُ لَتَنزِيلُ رَبِّ الْعَالَمِينَ

‘এটি নিঃসন্দেহে বিশ্বসমূহের রবের নাজিলকৃত।’ (সুরা আশ-শুয়ারা: আয়াত ১৯২)

৩. النور — ‘আলো’

وَأَنزَلْنَا إِلَيْكُمْ نُورًا مُّبِينًا

‘আর আমি তোমাদের প্রতি সুস্পষ্ট আলো নাজিল করেছি।’ (সুরা আন-নিসা: আয়াত ১৭৪)

৪. الموعظة — ‘উপদেশ’

قَدْ جَاءَتْكُم مَّوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ

‘তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে উপদেশ।’ (সুরা ইউনুস: আয়াত ৫৭)

‘আল্লাহর কিতাবের মূল ও বিশেষ নাম হিসেবে ‘القرآن’ প্রথম স্থানে ব্যবহৃত হয় এবং ‘الفرقان’ দ্বিতীয় স্থানে। বাকি নামগুলো তুলনামূলকভাবে বিস্তৃত অর্থ ও ব্যবহার ধারণ করে। তাই এই নামগুলো কেবল কুরআনেরই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অন্য প্রসঙ্গেও ব্যবহৃত হতে পারে।

কুরআনের গুণাবলি (صفات القرآن)

নিচে কুরআনে বর্ণিত প্রধান গুণাবলি তুলে ধরা হলো—

১. العظيم — ‘মহান’। আল্লাহ তাআলা বলেন—

وَالْقُرْآنَ الْعَظِيمَ

‘মহান কুরআন।’ (সুরা আল-হিজর: আয়াত ৮৭)

২. الكريم — ‘সম্মানিত’। আল্লাহ তাআলা বলেন—

إِنَّهُ لَقُرْآنٌ كَرِيمٌ

‘এটি অবশ্যই এক সম্মানিত কুরআন।’ (সুরা আল-ওয়াকিয়া: আয়াত ৭৭)

৩. المبين — ‘সুস্পষ্ট’। আল্লাহ তাআলা বলেন—

وَقُرْآنٍ مُّبِينٍ

‘এটি সুস্পষ্ট কুরআন।’ (সুরা আল-হিজর: আয়াত ১)

৪. الحكيم — ‘প্রজ্ঞাময়’। আল্লাহ তাআলা বলেন—

وَالْقُرْآنِ الْحَكِيمِ

‘প্রজ্ঞাময় কুরআনের শপথ।’ (সুরা ইয়াসিন: আয়াত ২)

৫. المبارك — ‘বরকতময়’। আল্লাহ তাআলা বলেন—

كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ

‘এক বরকতময় কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি নাজিল করেছি।’ (সুরা সাদ: আয়াত ২৯)

৬. المجيد — ‘গৌরবময়’। আল্লাহ তাআলা বলেন—

ق وَالْقُرْآنِ الْمَجِيدِ

‘ক্বাফ। গৌরবময় কুরআনের শপথ।’ (সুরা ক্বাফ: আয়াত ১)

৭. العزيز — ‘অপরাজেয়’

وَإِنَّهُ لَكِتَابٌ عَزِيزٌ

‘এটি অবশ্যই এক অপরাজেয় গ্রন্থ।’ (সুরা ফুসসিলাত: আয়াত ৪১)

৮. الهدى — ‘পথপ্রদর্শক’। আল্লাহ তাআলা বলেন—

هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ

‘মুত্তাকীদের জন্য হিদায়াত।’ (সুরা আল-বাকারা: আয়াত ২)

৯. الرحمة — ‘করুণা’

هُدًى وَرَحْمَةً لِّلْمُحْسِنِينَ

‘হিদায়াত এবং সৎকর্মশীলদের জন্য করুণা।’ (সুরা লুকমান: আয়াত ৩)

এছাড়াও অন্যান্য গুণাবলি:

১. الشّفاء (আশ-শিফা)

অর্থ: ‘আরোগ্য’ বা ‘উপশম’।

কুরআন মানুষকে মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে শোক ও দুঃখ থেকে আরোগ্য দেয়।

২. البلاغ (আল-বালাগ)

অর্থ: ‘প্রকাশ’ বা ‘বার্তা পৌঁছে দেওয়া’।

কুরআন হলো আল্লাহর বার্তার সুস্পষ্ট প্রকাশ, যা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব।

৩. البشير (আল-বাশীর)

অর্থ: ‘সুখবরদাতা’।

যারা আল্লাহর পথে চলে, তাদের জন্য কুরআন আনন্দের ও আশার বার্তা দেয়।

৪. النّذير (আন-নাযীর)

অর্থ: ‘সতর্ককারী’।

কুরআন লোকদের বিপদ, পাপ ও শাস্তির থেকে সতর্ক করে।

৫. البصائر (আল-বাসায়ের)

অর্থ: ‘দৃষ্টিসম্পন্নতা’ বা ‘দৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টি’।

এটি মানুষের অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচন করে, সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করে।

৬. الحقّ (আল-হক্ক)

অর্থ: ‘সত্য’।

কুরআন সত্যকে প্রকাশ করে, মিথ্যা ও বিভ্রান্তি থেকে মানুষকে রক্ষা করে।

৭. العلم (আল-ইলম)

অর্থ: ‘জ্ঞান’।

কুরআন মানুষের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা বৃদ্ধি করে, অজ্ঞানতা দূর করে।

৮. الصدق (আস-সিদ্দিক)

অর্থ: ‘সততা’ বা ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’।

এটি মানুষের বিশ্বাস ও মনকে দৃঢ় করে, জীবনকে ন্যায়ের পথে পরিচালিত করে।

৯. العَجَبُ (আল-‘আজাব)

অর্থ: ‘আশ্চর্য’ বা ‘বিস্ময়’।

কুরআনের বিষয়বস্তু, তার বানান ও অর্থ পাঠককে বিস্মিত করে।

১০. التذكرة (আত-তাযকিরা)

অর্থ: ‘স্মরণ করানো’ বা ‘উপদেশ’।

কুরআন মানুষকে তার করণীয় ও জীবনবোধের দিকে পুনরায় স্মরণ করায়।

১১. البيان (আল-বয়ান)

অর্থ: ‘ব্যাখ্যা’ বা ‘সুস্পষ্টতা’।

কুরআন বিষয়গুলোর অর্থ ও উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে।

১২. الوحي (আল-ওহি)

অর্থ: ‘ওহি’ বা ‘আল্লাহর নির্দেশ’।

কুরআন আল্লাহর সরাসরি ওহি, যা মানবজাতিকে পথ প্রদর্শন করে।

১৩. أحسن الحديث (আহসানুল হাদীস)

অর্থ: ‘সেরা বক্তব্য’ বা ‘সর্বোৎকৃষ্ট বাণী’।

কুরআনের ভাষা, ব্যাকরণ ও অর্থের দিক থেকে মানব ইতিহাসে সর্বোচ্চ ও সুন্দর।

কুরআনের নাম ও গুণাবলি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে যে বাস্তবতা উদ্ভাসিত হয় তা হলো—কুরআন হলো আল্লাহর অসীম জ্ঞানের মহাসমুদ্র। এই কিতাব শুধু পড়ার জন্য নয়; চিন্তা, অনুধাবন ও জীবনে প্রতিফলনের জন্য নাজিল করা হয়েছে।

কুরআনের নামের রহস্য আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যে এই গ্রন্থ কোনো সাধারণ কিতাব নয়। القرآن হলো চিরন্তন নির্দেশিকা, الفرقان হলো সত্য-মিথ্যাকে আলাদা করার শক্তি, الكتاب হলো নীতি ও বিধানগুলোর সংরক্ষণ, এবং الذكر হলো হৃদয়ের জাগরণ ও স্মরণ।

প্রতিটি নাম, প্রতিটি গুণাবলি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যে কুরআন শুধু পড়ার জন্য নয়—এটি অনুধাবনের, চিন্তার, এবং জীবনে প্রয়োগের জন্য নাজিল হয়েছে। এই নামগুলো আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য অনুভব করায়, আধ্যাত্মিক শান্তি দেয়, এবং মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হিদায়াত ও করুণা পৌঁছে দেয়।

আমরা যদি কুরআনের প্রতিটি নাম ও গুণাবলিকে গভীরভাবে অনুধাবন করি, তবে এর আলোকোজ্জ্বল পথ আমাদের জীবনকে সত্য, ন্যায় ও শান্তির দিকে পরিচালিত করবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে কুরআনের আলোয় জীবন গড়ার তাওফিক দিন। آمين يا رب العالمين।

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন