

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি ইতোমধ্যে ২৩৭টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করেছে। কিন্তু যুগপৎ আন্দোলনে থাকা শরিক দলগুলোর জন্য এখনো কোনো আসন চূড়ান্ত ঘোষণা হয়নি। এ অবস্থায় মিত্রদের মধ্যে উদ্বেগ, অস্বস্তি ও তৃণমূলে অসন্তোষ বাড়ছে।
শরিক রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ করছে, তাদের জন্য কোন কোন আসন ছেড়ে দেওয়া হবে সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা না হওয়ায় তারা প্রচারণায় পিছিয়ে পড়ছে এবং স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগেও দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তফসিল ঘোষণার সম্ভাবনা থাকায় তাদের মতে, এখনো সিদ্ধান্ত না এলে মাঠের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।
সূত্র জানায়, আরপিওর নতুন বিধান অনুযায়ী জোট গঠন করা গেলেও প্রত্যেক দলকে নিজেদের প্রতীকেই লড়তে হবে। ছোট দলগুলোর জন্য নিজস্ব প্রতীকে জয় পাওয়া কঠিন হওয়ায় বিএনপির উপর চাপ বাড়ছে আসন পুনর্বিন্যাসে। যদিও বিএনপি নিজের দলের মনোনয়ন প্রক্রিয়া প্রায় শেষ করেছে, তবুও শরিকদের আসন বিষয়ে তারা মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা ও সক্ষমতা যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে।
শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা জানান, একই আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রতিদিনই প্রচারণা, গণসংযোগ ও শোডাউন করছেন। এতে জোটপ্রার্থীদের অবস্থান দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি ভোটারদের মধ্যেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। পরিস্থিতি দ্রুত সমাধান না হলে উত্তেজনা বাড়তে পারে বলে তারা মনে করেন।
এদিকে আসন সমঝোতার বিষয়ে আলোচনার জন্য বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের কয়েকটি দল ও জোট নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে বৈঠক করেছেন।
বৈঠকে নেতারা বলেছেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির পক্ষ থেকে আসন ছাড় পাওয়া প্রার্থীদের সঙ্গে নতুন করে যেসব আসনে ছাড় দেওয়া হবে, তা দ্রুত ঘোষণা করা উচিত। কারণ, বিষয়টি ঝুলে থাকায় জোটের সম্ভাব্য প্রার্থীরা পুরোদমে নিজেদের আসনে প্রচারণায় নামতে পারছেন না। ওইসব আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরাও সক্রিয় থাকায় পরিস্থিতি আরো জটিল হচ্ছে। এতে বিভিন্ন আসনে বিএনপির সঙ্গে মিত্র দল-জোটগুলোর স্থানীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ঝামেলাও বাড়ছে।
তবে বিএনপি থেকে বলা হয়েছে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শিগগির এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্ররাও এখন তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের অপেক্ষায় রয়েছেন।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, শিগগির এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারে। এরপর শরিকরা কে কোন আসন থেকে নির্বাচন করবেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেওয়া হবে। দলটি একাধিক সূত্র জানায়, শরিকদের এবার সব মিলিয়ে ২৫ থেকে ৩০টি আসন ছাড় দেওয়া হতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমাদের স্থায়ী কমিটির বৈঠক আছে। সে বৈঠকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তার দাবি, মিত্রদলগুলোর আসন বিন্যাস নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। রাজনৈতিক অবস্থান ও দলগুলোর অবদান বিবেচনা করে শিগগিরই তাদের আসন ছাড়ের বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হবে।
এদিকে বিএনপির চাওয়া অনুযায়ী আন্দোলনের মিত্র প্রায় সব দলই তাদের প্রার্থী তালিকা জমা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত বিএনপির কাছে ১৬৮ জনের প্রার্থী তালিকা জমা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এর মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ছাড়া ছয় দলীয় জোট- গণতন্ত্র মঞ্চের বাকি পাঁচ দল ৪০ জন, ১২ দলীয় জোট ২১ জন, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট নয়জন, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য ১৯ জন, এলডিপি ১৩ জন, গণঅধিকার পরিষদ ২৫ জন, গণফোরাম ১৬ জন, এনডিএম ১০ জন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) পাঁচজন, বাংলাদেশ লেবার পার্টি ছয়জন এবং বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি) চারজনের প্রার্থী তালিকা দিয়েছে। তবে তালিকা জমা নেওয়ার পর শরিকদের কারো সঙ্গে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসেনি বিএনপি।
সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মিত্রদের আসন ঘোষণা দাবি জানিয়েছেন জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের প্রধান ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ।
তিনি বলেন, আমরা বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ছিলাম। আমাদের প্রত্যাশা, বিএনপি সঠিক মূল্যায়ন করবে। একই সঙ্গে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আসন ঘোষণা করার দাবি জানান তিনি।
গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষনেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, মনোনয়ন পেয়ে বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচনি প্রচারণাও শুরু করছেন।
অন্যদিকে জোটসঙ্গীদের আসন সমঝোতার বিষয়টি এখনো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অতি দ্রুত এ অবস্থার অবসান ঘটানো প্রয়োজন। কারণ এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির সঙ্গে শরিকদের এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। এটা বাড়তে দিলে এর রাজনৈতিক ঝুঁকি বড় হয়ে দেখা দিতে পারে।
সাইফুল হক মনে করেন, বিএনপিকে যেমন তার নিজ দলের প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি আন্দোলনের মিত্র প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করাও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তা না হলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রার্থী ঘোষণা নিয়ে বিএলডিপির চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, বিএনপি আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রাথমিকভাবে গ্রিন সিগন্যাল দিলেও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ঘোষণা দিচ্ছে না।
এতে আমাদের প্রতিনিয়ত বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। আমাদের দাবি, দ্রুত মিত্রদের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে মাঠে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে।
বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, বিএনপি যত দ্রুত জোটের প্রার্থী ঘোষণা করবে, ততই আমাদের জন্য কাজ করার সুযোগ বাড়বে। প্রার্থী ঘোষণার ধীরগতির কারণে তৃণমূলে প্রতিবন্ধকতা বাড়ছে। একদিকে আমরা প্রচারণা চালাচ্ছি, অন্যদিকে ধানের শীষের পক্ষে বিএনপির প্রার্থীরাও প্রচারণা চালাচ্ছে। এর ফলে নিজেদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি বাড়ছে।
যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর নেতাদের দাবি, বিএনপি প্রার্থীরা মাঠে নামলেও জোটপ্রার্থীদের নাম ঘোষণা না হওয়ায় তারা নির্বাচনি প্রচারে নামতে পারছেন না। অথচ তাদের আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রায় প্রতিদিনই নানা কর্মসূচি পালন, শোডাউন ও গণসংযোগ করছেন।
এ অবস্থায় মিত্র দলের প্রার্থীরা একই আসনে মাঠে নামলে একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে এবং সাধারণ ভোটাররাও বিভ্রান্তির শিকার হবেন বলে তারা মনে করেন।
মন্তব্য করুন