


আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম ও আশপাশের অঞ্চলে রাজনৈতিক তৎপরতা বেড়েছে।
বন্দরনগরী থেকে পাহাড়ি জেলা পর্যন্ত ভোটের মাঠে সরগরম পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দল নিজেদের প্রভাব বিস্তারে মাঠে নেমেছে।
তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, এখনো ‘শেষ কথা’ বলা সময় হয়নি। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকের ভোটকে ঘিরে সব দলই এখন নির্বাচনী অঙ্ক কষছে। চায়ের দোকান থেকে রাজনৈতিক কার্যালয়—সব জায়গাতেই চলছে কে জিতবে, কে হারবে সেই আলোচনা।
ঐতিহাসিকভাবে চট্টগ্রাম বিএনপির অন্যতম শক্ত ঘাঁটি। অতীতের সুষ্ঠু নির্বাচনে অধিকাংশ আসনে জয় এসেছে ধানের শীষ প্রতীকে। তবে দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা এবং অভ্যন্তরীণ বিভক্তি দলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
নতুন ভোটার ও নারী ভোটারদের কাছে দলটি কতটা গ্রহণযোগ্য হতে পারবে—এখন সেটাই বড় প্রশ্ন। অনেকেই মনে করছেন, বিএনপির আত্মবিশ্বাস যেমন শক্তি হতে পারে, তেমনি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস আবার উল্টো ফলও আনতে পারে।
এর বিপরীতে জামায়াতে ইসলামী প্রায় সব আসনেই আগে থেকেই প্রার্থী ঘোষণা করেছে এবং মাঠে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। তাদের নারী ও অঙ্গসংগঠনও গণসংযোগে ব্যস্ত। সামাজিক ও কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভোটারদের কাছে যাওয়ার কৌশল নিচ্ছে তারা।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতাদের জামায়াতবিরোধী বক্তব্য এবং এনসিপিসহ কয়েকটি ইসলামী দলের সমালোচনামূলক মন্তব্যে দলটি কিছুটা চাপের মুখে পড়েছে।
বিএনপির ভেতরে দ্বন্দ্ব, বহিরাগত প্রভাব : বিএনপির তৃণমূল কর্মীদের অভিযোগ—দলটি নানা দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিংয়ে জর্জরিত। কেউ চাঁদাবাজি বা দখলবাজিতে জড়িয়ে পড়েছেন, আবার কেউ ভিন্ন মতাবলম্বী হয়ে গেছেন। এতে মাঠে নেতাকর্মীদের ঐক্য নষ্ট হচ্ছে।
অন্যদিকে, নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কিছু প্রভাবশালী সমর্থককে টানার প্রতিযোগিতায়ও নামছে বিএনপি ও জামায়াত—যা স্থানীয় পর্যায়ে নতুন সমীকরণ তৈরি করছে।
২৩ আসনের মাঠে সম্ভাবনা ও বাস্তবতা
চট্টগ্রাম বিভাগের ২৩টি আসনের মধ্যে প্রায় ১৫টিতে বিএনপি, ৭টিতে জামায়াত এবং একটি আসনে এলডিপি শক্ত অবস্থানে আছে বলে স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা। তবে সময়ের সঙ্গে প্রভাব বলয় বদল হলে অবস্থানও পরিবর্তিত হতে পারে।
মীরসরাই (চট্টগ্রাম-১): বিএনপির ভেতরে তীব্র কোন্দল, মনোনয়ন অনিশ্চিত। জামায়াতের প্রার্থী ও সংগঠন মাঠে সক্রিয়—তাদের এগিয়ে রাখছেন বিশ্লেষকরা।
ফটিকছড়ি (চট্টগ্রাম-২): ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী ভোট বেশি। বিএনপি বিভক্ত, জামায়াত সংগঠিত—এখানে দাঁড়িপাল্লা এগিয়ে।
সন্দ্বীপ (চট্টগ্রাম-৩): বিএনপি ঐতিহ্যগতভাবে শক্তিশালী, কিন্তু এবার প্রার্থী নিয়ে টানাপোড়েন। জামায়াতের মাঠে উপস্থিতি বাড়ছে।
সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম-৪): বিএনপিতে নেতৃত্ব সংকট। জামায়াত নির্ধারিত প্রার্থী নিয়ে সক্রিয়। এ আসনে বিএনপির আসলাম চৌধুরীকে হারিয়ে দিতে পারেন জামায়াতের আনোয়ার সিদ্দিক চৌধুরী।
হাটহাজারী (চট্টগ্রাম-৫): হেফাজতের প্রভাব এখানে গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপিতে মনোনয়ন জটিলতা আছে, তবে ঐক্য ফিরলে আসনটি বিএনপির হতে পারে। তবে এখানে যদি ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীকে জামায়াত আসন ছেড়ে দেয় তাহলে বিএনপির জন্য সমস্যা হতে পারে।
রাউজান (চট্টগ্রাম-৬): বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘাত অব্যাহত, তবে সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রার্থী হলে সুবিধা থাকবে বিএনপির।
রাঙ্গুনিয়া (চট্টগ্রাম-৭): শহীদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ঐতিহ্যের কারণে এটি বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে বিবেচিত।
বোয়ালখালী–চান্দগাঁও (চট্টগ্রাম-৮): বিএনপি ঐক্যবদ্ধ হলে জয় সম্ভাবনা বেশি। জামায়াত প্রার্থী মাঠে থাকলেও প্রভাব সীমিত।
কোতোয়ালি–বাকলিয়া (চট্টগ্রাম-৯): প্রতীকী আসন হিসেবে পরিচিত। বিএনপি এগিয়ে, তবে গ্রুপিং বড় সমস্যা। জামায়াত এখানে সংগঠিতভাবে প্রচারে।
ডবলমুরিং–পাহাড়তলী (চট্টগ্রাম-১০): বিএনপির ঐতিহাসিক প্রভাব আছে, প্রার্থী নিশ্চিত না হলেও বিজয় সম্ভাবনা বেশি।
বন্দর–পতেঙ্গা (চট্টগ্রাম-১১): আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর প্রার্থী হওয়া প্রায় নিশ্চিত, বিএনপির ঘাঁটি হিসেবেই বিবেচিত।
পটিয়া (চট্টগ্রাম-১২): ঐতিহ্যগতভাবে বিএনপির শক্ত আসন, এবারও তাই থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আনোয়ারা–কর্ণফুলী (চট্টগ্রাম-১৩): প্রার্থী নির্বাচনে সতর্ক হলে বিএনপি সুবিধাজনক অবস্থায়।
চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম-১৪): এলডিপি চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ জোটের প্রার্থী হলে তার জয় সম্ভাবনা প্রবল।
সাতকানিয়া–লোহাগাড়া (চট্টগ্রাম-১৫): জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি, বিএনপি এখনো অসংগঠিত।
বাঁশখালী (চট্টগ্রাম-১৬): জামায়াত মরিয়া হলেও বিএনপির ঐতিহাসিক প্রভাব এখনো বজায়। তবে এখানে জামায়াত প্রার্থী বিজয়ী হতে পারেন। কারণ তিনি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান।
পাহাড়ি জেলায় ধীরগতির রাজনীতি
রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে বিএনপি ও জামায়াত উভয়ের তৎপরতা এখনো সীমিত। তবে স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী ঘরানার নিষ্ক্রিয়তা তাদের জন্য সুবিধা তৈরি করছে।
কক্সবাজারেও বিএনপি-জামায়াত মুখোমুখি
কক্সবাজারের চারটি আসনেই বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যাচ্ছে।
চকরিয়া-পেকুয়া (কক্সবাজার-১): সালাউদ্দিন আহমদের জনপ্রিয়তা বিএনপির পক্ষে, তবে জামায়াত কৌশলে মাঠে সক্রিয়।
মহেশখালী-কুতুবদিয়া (কক্সবাজার-২): বিএনপির কোন্দল চলমান, জামায়াত অনেক আগে থেকেই প্রচারে।
সদর-রামু-ঈদগাঁও (কক্সবাজার-৩): বিএনপি দুই ভাগে বিভক্ত, জামায়াত নতুন করে অবস্থান শক্ত করতে চায়।
উখিয়া-টেকনাফ (কক্সবাজার-৪): শাহজাহান চৌধুরীর প্রভাব এখনো প্রবল, তবে জামায়াতও জনপ্রিয় প্রার্থী নিয়ে মাঠে নেমেছে।
অন্য দলগুলোর মধ্যে এবি পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস ও এনসিপি প্রার্থী ঘোষণা করলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
মন্তব্য করুন