


আওয়ামী লীগ শাসনামলে ২০০১ সালে বিসিএস ২০ ব্যাচের নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয়। এই নিয়োগে অল্প কিছু মেধার ভিত্তিতে দিলেও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ কর্মীদের নিয়োগের অভিযোগ ওঠে।
বিতর্কিতভাবে নিয়োগের পর গত ১৫ বছর প্রশাসন ক্যাডারকে দলীয়করণে ব্যাপক ভূমিকা রাখে এই ব্যাচের কর্মকর্তারা। ২০১৮ সালের রাতের ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে অবৈধভাবে ক্ষমতায় নিয়ে আসায় ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধশত কর্মকর্তাকে ওএসডি এবং বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো এবং অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন করা হয়। আওয়ামী সুবিধাভোগী এসকল কর্মকর্তাদের তদবিরে আটকে আছে এই ব্যাচের মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের পদোন্নতি। জনপ্রশাসন সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের নিয়মিত ২০ ব্যাচের যুগ্মসচিব পদোন্নতি হয় ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর। যুগ্মসচিব হিসেবে ২ বছর সন্তোষজনক চাকরির পর যেখানে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতিযোগ্য হন। অথচ নিয়মিত পদোন্নতি পাওয়া এসকল যুগ্মসচিবের পদোন্নতির ৪ বছর ইতমধ্যে পার হলেও ২০তম ব্যাচের উপযুক্ত অফিসারদের পদোন্নতি হচ্ছে না। অথচ অতিরিক্ত সচিবের স্বল্পতার জন্য অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বিভিন্ন অনুবিভাগে পদায়ন করা যাচ্ছে না। একজন অতিরিক্ত সচিব দুই বা ততোধিক অনুবিভাগের দায়িত্ব পালন করছেন। অনেক সংস্থা ও কর্পোরেশনে চেয়ারম্যান, প্রধান নির্বাহী ও মহাপরিচালক পদ শূন্য থাকার পরেও কর্মকর্তা স্বল্পতার কারণে পদায়ন করা যাচ্ছে না।
জনপ্রশাসন সূত্র আরও জানায়, অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহ শুরু করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রত্যেক কর্মকর্তার কর্ম জীবনের সমস্ত নথিপত্র, প্রয়োজনীয় নম্বর, চাকরি জীবনের শৃঙ্খলা, দুর্নীতির বিষয়সহ সামগ্রিক বিষয়ের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। বিগত সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীদের পিএস ছিল, প্রধানমন্ত্রীর পিএস, এপিএস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক, মহাপরিচালক, ২০১৮ সালের নৈশ নির্বাচনে ডিসি হিসেবে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছে এবং বিভিন্নভাবে বিগত সরকারের প্রতি অন্ধ আনুগত্য দেখিয়েছে তাদের পদোন্নতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
পদোন্নতির জন্য গত ৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে ৫টি সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরই মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে ছাত্রলীগের কোটায় নিয়োগ পাওয়া আওয়ামী সুবিধাভোগী কর্মকর্তরা। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের চেয়ে দলীয় সরকার ক্ষমতায় আসলে এমপি-মন্ত্রীদের ম্যানেজ করে পদোন্নতি নিশ্চিত করা যাবে মনে করে যে কোন মূল্যে পদোন্নতি ঠেকানোর চেষ্টা চালায়। ইতমধ্যে এসকল কর্মকর্তারা সরকারের কয়েকজন সচিব, একাধিক উপদেষ্টাকে ম্যানেজ করে অতিরিক্ত সচিব পদোন্নতি আটকে রেখেছে।
কর্মকর্তাদের অভিযোগ, অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করা কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালের দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করা একান্ত সচিব এবং শেখ হাসিনার সাবেক মূখ্য সচিব আবদুস সোবহান শিকদারের একান্ত সচিব ড. মো: ফেরদৌস আলম। এই কর্মকর্তা অর্থমন্ত্রণালয়ের সচিব ও এসএসবির সদস্য ড. মো: খাইরুজ্জামান মজুমদারের মাধ্যমে পদোন্নতি আটকে দিতে প্রভাব বিস্তার করছেন।
পদোন্নতি আটকে দিতে প্রভাব বিস্তার করা কর্মকর্তা হলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ নাজমুল আবেদীন। শেখ হাসিনার শাসনামলে দীর্ঘ সাড়ে ৭ বছর বিদ্যুৎ বিভাগে কর্মরত থেকে আদানির চুক্তি সংক্রান্ত কাজে জড়িত থাকা এই কর্মকর্তা নিজ এলাকা চট্রগ্রামের একটি গ্রুপকে ম্যানেজ করে পদোন্নতি আটকে রাখার চেষ্টা করছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া একজন সিনিয়র সচিবকে ম্যানেজ করে পদোন্নতি আটকে রাখার চেষ্টা করছেন শেখ হাসিনার সময়ের সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ ইফতেখার হোসেন। এই সিনিয়র সচিব ছাড়াও নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে পারে এমন একটি রাজনৈতিক দলের সিনিয়র নেতার মাধ্যমে পদোন্নতি আটকে রাখার চেষ্টা করছেন।
নিজ মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং উপদেষ্টাকে ম্যানেজ করে পদোন্নতি আটকে রাখার চেষ্টা করছেন ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মুহাম্মদ মনজুরুল হক এবং একই মন্ত্রণালয়ে দিল্লীতে ইকোনোমিক মিনিস্টার হিসেবে ৫ বছর কাজ করা সালমান এফ রহমানের ঘনিষ্ট কর্মকর্তা মোহা. রাশেদুল আমীন। তাকে আইএফআইসি ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ সম্বলিত অডিও সামাজিক মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রভাবশালী একজন উপদেষ্টাকে ম্যানেজ করে পদোন্নতি আটকে দিয়েছেন নিজেকে ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে দাবি করা সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ারের ঘনিষ্ট পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান। এছাড়াও অনুভবে বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের ২৫ জন লেখক এবং রাতের ভোটের ওএসডি হওয়া ৩৯ জন সাবেক জেলা প্রশাসক পদোন্নতি আটকে দিতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বর্তমানে অতিরিক্ত সচিবের ৪১৮টি পদের ৩৩০টিতে কর্মকর্তা আছে। শূন্য পড়ে আছে ৮৮টি পদ। আগামি বছরের ৩১ জানুয়ারি শূন্য পদের সংখ্যা হবে ১৩০টি। ঐ বছরের ৩০ জন শূন্য পদ থাকবে ১৫৮টি।
বিসিএস ৮ম ব্যাচ থেকে ১৮তম ব্যাচ পর্যন্ত যুগ্মসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির পরিসংখ্যানে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। ৮ম ব্যাচের কর্মকর্তারা যুগ্মসচিব পদে ৩ বছর ৪ মাস কাজ করার পর ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। ৯ম ব্যাচের কর্মকর্তারা যুগ্মসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন ২ বছর ৮ মাস পর। ১০ম ব্যাচের কর্মকর্তারা ৩ বছর ৪ মাস পর ২০১৮ সালে ২৯ আগস্ট পদোন্নতি পান অতিরিক্ত সচিব হিসেবে। ১১তম ব্যাচের কর্মকর্তারা যুগ্মসচিব হওয়ার ২ বছর ১১ মাস পর ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন। ১৩তম ব্যাচের কর্মকতারা দুই ধাপে যুগ্মসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদোন্নতি পান। কিছু কর্মকর্তা ২ বছর ৯ মাস পর ২০২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ও কিছু কর্মকর্তা ৩ বছর ৮ মাস পর ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পদোন্নতি পান অতিরিক্ত সচিব হিসেবে। ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারা যুগ্মসচিব হওয়ার ৩ বছর ৬ মাস পর ২০২২ সালের ৬ এপ্রিল অতিরিক্ত সচিব হন। ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা যুগ্মসচিব হওয়ার তিন বছর ১১ মাস পর ২০২৩ সালের ১২ মে অতিরিক্ত সচিব হন। ১৮তম ব্যাচের কর্মকর্তারা যুগ্মসচিব হওয়ার ৩ বছর ১০ মাস পর ২০২৪ সালের ২২ এপ্রিল অতিরিক্ত সচিব পদোন্নতি পান। কিন্তু ২০ তম ব্যাচের কর্মকর্তারা ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর যুগ্ম সচিব হওয়ার ৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা একই পদে চাকরি করছেন।
পদছাড়া পদোন্নতিকে প্রথম অনাচার আখ্যা দিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাবেক সচিব জানান, পৃথিবীর কোথাও এমন প্রমাণ নেই, যে পদ ছাড়াই পদোন্নতি হয়। যদি পদ শূন্য থাকে আর উপযুক্ত লোক থাকে তাহলে সময় মতোই পদনিতন্ন হওয়া উচিৎ। সঠিক যাচাইবাছাই করে পদ দেয়া উচিৎ। অনিয়ম করে পদোন্নতি দিলে যোগ্যদের মধ্যে হতাশা কাজ করে, যা প্রশাসনের মধ্যেও বিরূপ প্রভাব ফেলে। চুক্তিতে নিয়োগ হলে পদায়নের সুযোগ নেই বলেও মনে করেন তারা।
মন্তব্য করুন