


আগামী ১৭ ডিসেম্বর (বুধবার) অনুষ্ঠিত হবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) দ্বাদশ সমাবর্তন। সমাবর্তনে প্রধান অতিথি ও সমাবর্তন বক্তা হিসেবে থাকবেন শিক্ষা উপদেষ্টা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা। এদিকে কর্মদিবসে সমাবর্তনের দিন নির্ধারণ, কাঙ্ক্ষিত অতিথি না পাওয়া ও রেজিস্ট্রেশনের সময় না বাড়ানো নিয়ে রেজিস্ট্রেশনকারী ও রেজিস্ট্রেশন বঞ্চিত সাবেক অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যেই অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছেন, নির্ধারিত সময়ে ও নির্ধারিত অতিথিদের নিয়েই সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ ৭২ বছরের ইতিহাসে মাত্র ১১টি সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ একাদশ সমাবর্তনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৯ সালে। অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ সমাবর্তনের তারিখ বারবার পিছানোর কারণে এটি একটি আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে।
সর্বশেষ চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি দ্বাদশ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও তা একই বছরের ১৩ জানুয়ারি স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এর আগে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে কয়েকবার তারিখ দিয়েও পরে অনিবার্য কারণবশত সমাবর্তন স্থগিত করা হয়েছিল।
দ্বাদশ সমাবর্তনের জন্য রেজিস্ট্রেশনকারী আলী ইউনুস হৃদয় নামে সাবেক এক শিক্ষার্থী বলেন, দ্বাদশ সমাবর্তনে অনেকেই রেজিস্ট্রেশন করতে পারেনি। সমাবর্তন ফি ও সময় বিবেচনায় অনেকের চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আবার কেউ আর্থিক সংকটেও ছিলেন জন্যই কঠিন ছিল! আমার পরিচিত অনেকেই আশা করেছিলেন, প্রশাসন রেজিস্ট্রেশন করার সুযোগ হয়তো দিবে। আর এর মাঝে সময়ও বেশ গড়িয়েছে, তবুও রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ বাড়ানো হয়নি! কয়েকদিন আগেই জানতে পারি সমাবর্তন আয়োজন হতে যাচ্ছে।
সমাবর্তনের অতিথি বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, দীর্ঘ শিক্ষা জীবনের গ্র্যাজুয়েশন শেষে ৫ বছর পর সমাবর্তন হচ্ছে। সেই সমাবর্তন ঘিরে গ্র্যাজুয়েটদের প্রত্যশা পূরণ হবে সেটিই প্রত্যাশিত ছিল। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সময় ও সক্ষমতা বিবেচনায় সেটি করতেই পারে। তারিখ নিয়েও ভিন্নমত ছিল তবুও ভেবেছিলাম, এতোবড় আয়োজনের জন্য একটি দিনের হিসাব, গ্র্যাজুয়েট হিসেবে সহজেই মানিয়ে নেয়া উচিত। কিন্তু অতিথি আর সমাবর্তন বক্তা নির্ধারণের বিষয়ে বেশিরভাগ গ্র্যাজুয়েট হতাশ ও মর্মাহত হয়েছেন। এই হতাশা উত্তরণের সময়োপযোগী পদক্ষেপ প্রশাসন গ্রহণ করতে পারে বলে এখনও বিশ্বাস করি।
সারমিন বন্ধন নামে আরেক সাবেক শিক্ষার্থী বলেন, দুঃখের বিষয় প্রশাসন আমাদের দাবির বিষয়গুলো আমলেই নিচ্ছে না। ডোন্ট কেয়ার টাইপ।
সমাবর্তন আয়োজনের অসঙ্গতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লেখালেখিও করছেন সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের অনেকে।
মো. রেজাউল করিম নামে এক সাবেক শিক্ষার্থী 'রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিার' নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে লিখেছেন, সত্যি কি এটা সমাবর্তন? নাকি প্রশাসনের দায় শেষ করার দায়িত্ব? একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন কতটা আনন্দের তা বলে বুঝানো কঠিন। আমাদেরওতো কত আশা ছিলো সমাবর্তন ঘিরে। কিন্তু মাননীয় ভিসি স্যার সকল আশাগুলো গলা টিপে ধরলেন। সমাবর্তন নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই।
কিছুটা অভিমান প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, একেতো ডেট দেওয়া হয়েছে কোন অফ ডে বিবেচনা না করে। তারপরে গেস্ট বিবেচনায় তারা ব্যর্থতার দায় স্বীকার করেছেন। তবে আমাদের কথা হলো এতো তাড়া কিসের? আরও এক বছর পিছানো হতো! তা না করে ব্যর্থতাকে মেনে নিয়ে সমাবর্তনের দায়িত্ব শেষ করতে কে বলেছে? এখন আমরাতো ভার্সিটির কেউ না সাবেক হয়ে গেছি! সাবেক হলে গুরুত্ব কমে। সাথে ভাবনাও থাকে না তাদের নিয়ে কারো। হয়তো কোনো একদিন শেষবারের মতো ক্যাম্পাসে গিয়ে অভিমানের সাথে সার্টিফিকেটটি নিয়ে আসবো। মাননীয় ভিসি স্যার হয়তো তখন ব্যস্ত থাকবেন নতুন কোন সমাবর্তনের চিন্তায়, নতুন কোন অতিথির আমন্ত্রণপত্রের চাপে কিংবা দায় কাটানোতে।
সমাবর্তন আয়োজনের অসঙ্গতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি পোস্ট করেছেন রাকসু'র জিএস সালাহউদ্দিন আম্মার।
সাবেক শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি লিখেছেন, সমাবর্তন নিয়ে সাবেক অনেক ভাই-বোন নক দিচ্ছেন, অনেকে মেনশন করে পোস্ট দিচ্ছেন যে রাকসু প্রতিনিধিরা থাকতে এই দায়সারা সমাবর্তন কিভাবে হচ্ছে। এটার একটাই উত্তর যে প্রশাসন রাকসুকে, রাকসুর সিদ্ধান্তকে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে বা এই জায়গা গুলোতে কতোটুকু এক্সেস দিচ্ছে। আমি রাকসু প্রতিনিধি হিসেবে নয় বরং আপনাদের জায়গায় থাকলে অনেক আগেই বয়কট করতাম।... এটা কোনো সমাবর্তনের ধারেকাছেও নাই, যাদেরকে অতিথি করেছে তারা সকল শিক্ষার্থীর চাওয়ার মতো কোনো মানুষ না।
সমাবর্তনের আমন্ত্রিত অতিথিদের থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়ার মতো কিছুই নেই উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ফার্মের মুরগী উপদেষ্টা এনে গ্রামের হাইস্কুলের নবীন বরণ হবে, সমাবর্তন নয়। এই উপদেষ্টারা সিলেক্টেড, ইলেক্টেড কোনো মন্ত্রী না। তাও আবার সিলেক্টেড বিভিন্ন দল, কোটা, এনজিও বেসিসে। এদের থেকে যদি বলি রাকসুর ভিপি এই প্রোগ্রামে গেস্ট স্পিকার হয় সেটা আরো গ্রহনযোগ্য হবে। কারন সে শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত। এখন বলতে পারেন ডক্টর ইউনুসও তো সিলেক্টেড কিন্তু ইউনুস গোটা দেশের মানুষের সিলেকশন আর বাকি যারা আসছে কে কিসের ভিত্তিতে আসছে, সেটা সবাই জানে। যারা সমাবর্তনের অতিথি তাদের থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়ার মতো কিছুই নেই।
সমাবর্তন বর্জনের পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও লিখেছেন, আমি কিছু বললেই বলবেন উস্কানি দিচ্ছি। তারপরও বলি, সাবেক ভাইবোনেরা যদি চান একযোগে বলেন সমাবর্তন লাগবেনা, প্রশাসনকে চাপ দিয়ে টাকা ফেরত নিয়ে নেন আর না হলে সমাবর্তনের দিন আরেকটা ছায়া সমাবর্তন করেন। সেখানে আমাদের ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন ধরে চায়ের কাপে রাজনীতি শেখানো মামাদের গেস্ট করেন, আমিও থাকবো সেখানে। আর যদি এই সমাবর্তন মেনে নিতে পারেন তো এটাতে অংশগ্রহণ করেন।
তবে, নির্ধারিত তারিখে এবং নির্ধারিত অতিথিদের নিয়েই সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন রাবি উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মো ফরিদ উদ্দিন খান। তিনি বলেন, নির্ধারিত তারিখে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের বিষয়ে আমাদের দিক থেকে কোনো সংশয় নেই। চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে।
অতিথি বিষয়ে তিনি বলেন, সমাবর্তনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে সভাপতিত্ব করার নিয়ম থাকলেও বর্তমান বাস্তবতায় উনাকে আমরা পাচ্ছিনা। আমরা মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। কিন্তু উনার আগ্রহ থাকলেও কিছু কৌশলগত কারণে তিনিও আমাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি। শেষ পর্যন্ত আমরা শিক্ষা উপদেষ্টা মহোদয়কে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। সাথে আমরা পরিকল্পনা উপদেষ্টা মহোদয়কে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করেছি এবং উনাকে আগেরবার শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। ফলে এই মুহূর্তে অতিথির বিষয়টি সেটেল্ড।
অনুষ্ঠানের তারিখ ও পুনঃরেজিস্ট্রেশনের সুযোগ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, দিনের ব্যাপারে আমাদের পছন্দ এবং চেষ্টা ছিল বৃহস্পতিবার অথবা রবিবার ঠিক করা। কিন্তু সম্মানিত অতিথিদের সময়ের সাথে সমন্বয় করতে গিয়ে আমরা সেটি পারিনি। শেষ পর্যন্ত বুধবার করতে হয়েছে। এতে আমাদের চাকুরীজীবী গ্র্যাজুয়েটদের একটু অসুবিধা হবে। এই অসুবিধার জন্য আমরা দুঃখিত। কিন্তু আমাদের উপায় ছিলনা।
এছাড়া পুন:রেজিস্ট্রেশন এর সুযোগ দেবার জন্য অনেকে দাবি বা অনুরোধ করেছেন। বিষয়টি আমাদের মূল কমিটিতে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু টেকনিক্যাল কারণে এ বিষয়ে সুযোগ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। নতুন করে যারা রেজিস্ট্রেশন করতে আগ্রহী ছিলেন তাদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করছি।
মন্তব্য করুন