

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


“আমি বাঁচতে চাই, আমাকে বাঁচান” স্বামীর আগুনে দগ্ধ শরীর নিয়ে বাচার আকু্তীতে ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে গুরুতর দগ্ধ হয়ে গত ২৫ দিন ধরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন গৃহবধূ ইসরাত জাহান সাথী (৩২)। কিন্তু পাশে নেই কেউই।
মাদকসেবী স্বামীর মাদক সেবনে বাধা দেওয়ায় দুজনের মধ্যে কলহ শুরু হলে এক পর্যায়ে সাথীর গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেয় স্বামী রুবেল (৩৫)। ভয়াবহ আগুনে ভুক্তভোগী এই নারীর শরীর পুরলেও এগিয়ে আসেনি রুবেল। পরবর্তীতে চেচামেচি শুনে প্রতিবেশিরা এগিয়ে এসে সাথীকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। তার শরীরের প্রায় ৭০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
বর্তমানে সাথী মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে রংপুরে রেফার্ড করলেও অর্থের অভাবে যেতে পারছেন না তিনি। এমনকি নিয়ে যাওয়ারো কেউ নেই এ অবস্থায় সরকারি সহায়তা চান সাথী।
জানা গেছে, ভুক্তভোগী সাথীর জন্ম ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সালন্দর ইউনিয়নের চৌধুরীহাট বন্দিকার্ডা এলাকয়। জন্মের পরপরই বাবা-মা মারা যান। এর পর শহরের হাজীপাড়া এলাকার ইমাম উদ্দিন-বিলকিস বানু দম্পতির কাছেই বড় হন সাথী।
এরপর ২০১২ সালে তাকে বিয়ে দেন পালিত মা-বাবা। তবে ওই সংসারে ৪ বছরের এক মেয়ে ও ৯ বছরের একটি ছেলে রেখে। প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী রুবেল হোসেনের সঙ্গে। পরবর্তীতে তাকে বিয়েও করেন। এর পরথেকেই নানান নেশায় জরিয়ে পরে রুবেল সংসারে বাড়তে শুরু করে ঝগড়া ঝামেলা।
ইশরাত জাহান সাথী বলেন, আমি বাঁচতে চাই। আমাকে বাঁচান। আমি আবার হাঁটতে চাই, নিজের হাতে খেতে চাই। কিন্তু ডাক্তার বলেছে উন্নত চিকিৎসা দরকার। তবে সেই টাকা আমার নেই। আমার ঘুমাতে খুব ইচ্ছা করতেছে। এখান থেকে আমাকে ইঞ্জেকশন ওষুধ কিছুই দিচ্ছে না।
জ্বালাপোড়া করছে স্যালাইন চাচ্ছি সেটাও দিচ্ছে না। ২৪ ঘণ্টায় আমার ৫-৬ মলমের প্রয়োজন, কিন্তু হাসপাতাল থেকে তো কিছুই দিচ্ছে না। শুধু সামান্য দুইটা ট্যাবলেট দেয়। আর ডাক্তার আসলে শুধু বলে বাড়ি চলে যান। আমি এ অবস্থায় যাব কোথায়?
সাথী বলেন, একদিন স্বামী মাদক সেবন করছিলেন, আমি তাতে বাধা দেই। এতে সে রাগে ক্ষোভে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমি ভালোবাসায় বিশ্বাস করতাম। এখন ভয় লাগে। আমার স্বামী আগুন দিয়েছে, কিন্তু তার চেয়ে বড় আগুন হচ্ছে এই অবহেলা। কেউ আমার খোঁজ নেয় না। না আমার শ্বশুরবাড়ির কেউ, না আমার নিজের পরিবার।
আমি শুধু চাইছিলাম ওটা (স্বামী) মাদক খাওয়া ছাড়ুক। কিন্তু সেদিন আগুন দিয়ে হাসতে লাগলো। প্রতিবেশীরা না এলে হয়তো আজ আমি বাঁচতাম না।
সাথী আরো বলেন, আমার দুই বছর বয়স থেকেই আমি অন্যের বাড়িতে মানুষ হয়েছি। আমি এতিম, বাবা নেই। যাদের মা-বাবা পরিচয় দিয়ে বড় হয়েছি তারাও আজ আমার এই করুণ দিনে পাশে নেই। প্রেম করে বিয়ে করেছি। ভালোবাসার টানে পরিবারকে উপেক্ষা করে নতুন সংসার গড়েছি। প্রথম কয়েক মাস ভালোই ছিল।
কিন্তু তারপরই বাস্তবতা বদলে যায়। স্বামী নেশায় জড়িয়ে পড়েন-মাদক সেবন, অর্থের অভাব, ঝগড়া, গালাগালি-সবই ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। তবুও আমি চুপ ছিলাম। ভাবতাম মানুষটা একদিন বদলে যাবে। সে মানুষজন বাসায় এনে মাদকের ব্যবসা করে। নিজে মাদক খায়। অথচ আমি দিনের পর দিন না খেয়ে থাকি। এক মুঠো ভাতের জন্য তার কাছে অনেক মার খেয়েছি। সে আমাকে হাত-পা বেঁধে পেটায়। খাবার দেয় না। তারপরও সব যন্ত্রণা সহ্য করে সংসার করতে চেয়েছিলাম। বাঁচতে চেয়েছিলাম নতুন পরিচয়ে।
আর সাথীর অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন হাসপাতালের অন্যান্যরাও বলেন, মেয়েটা খুবই অসহায়। কেউ আসে না তাকে দেখতে। সে যে খাবার খাবে সেটাও খেতে পারে না। হাত অচল। আমরাই তার মুখে খাবার তুলে দেই। আমরা না থাকলে না খেয়ে পড়ে থাকে। আর ব্যথায় কাতর হয়ে যায়।
তারা আরও বলেন, আজ আমরা আছি কাল থাকবো না তখন মেয়েটার কী হবে? মেয়েটার দিকে দেখে আমাদের খুবই খারাপ লাগছে। মানুষ এতোটা কীভাবে নিষ্ঠুর হতে পারে। দেশে কি আইন নেই। এখনো কীভাবে তার স্বামী বাইরে থাকে। পুলিশ তাকে ধরছে না কেন। আর পরিবারেই বা কেমন খোঁজ-খবর নেয় না।
লামিয়া নামে হাসপাতালের এক নার্স এনপিবিকে বলেন, সাথী খুব সাহসী মেয়ে। এত কষ্টের মধ্যেও কাঁদে না। কেবল কখনো বলে আমি কী আর বাঁচব? তখন আমাদেরও চোখে পানি আসে। আর তার স্বামীও আসে না আর দেখতে শুরুতে আসতো এখন আর কেউ আসে না।
ইসরাত জাহান সাথীর কথা শুনে ২৫ দিন পর দেখতে জান ঠাকুরগাঁও সিভিল সার্জন মোঃ আনিছুর রহমান, এনপিবিকে বলেন, ভুক্তভোগীর প্রায় ৬০-৭০ সতাংস দগ্ধ হয়েছে। এ অবস্থায় তার উন্নত চিকিৎসার জন্য আমরা তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো এবং ইতিমধ্যেই আমি চিকিৎসক ও আরএমও এবং সমাজসেবা অফিসার কে নির্দেশনা দিয়েছি।
আর ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা বলেন, ভুক্তভোগী সাথীর চিকিৎসা যেন যথাযথভাবে হয়, সেজন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থাও করা হবে।
মন্তব্য করুন