রবিবার
১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
রবিবার
১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সমুদ্র সৈকতেই ঢালা হচ্ছে হোটেলের ময়লা পানি

কক্সবাজার প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ০২:৫৭ পিএম
সমুদ্র সৈকতেই ঢালা হচ্ছে হোটেলের ময়লা পানি
expand
সমুদ্র সৈকতেই ঢালা হচ্ছে হোটেলের ময়লা পানি

কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতের ইসিএ (ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া)- ঘেরা এলাকায় দাঁড়িয়ে আছে ১২তলা বিশিষ্ট তারকা মানের দি সি-প্রিন্সেস হোটেল। পর্যটকদের আকর্ষণীয় নাম-টাইমলাইন, ঝলমলে বিজ্ঞাপন, আলোকসজ্জা- সবই আছে। নেই শুধু পরিবেশ সচেতনতা। নেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ন্যূনতম কাঠামো।

হোটেলটিতে নেই স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি)। ফলে হোটেলের সব ময়লা পানিই সরাসরি গিয়ে পড়ছে সৈকতের বালিয়াড়িতে- তারপর সেখান থেকে সমুদ্রে। বছরের পর বছর এই অবস্থা চললেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

সরেজমিনে যা দেখা গেল, ইসিএ এলাকায় সৈকতের দিকে তাকালে দূর থেকেই চোখে পড়ে এক অস্বাভাবিক দৃশ্য- বালিয়াড়ির গায়ে কচুগাছের একঘেঁয়ে সারি। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে, কেউ যেন বাগান করেছে। কিন্তু কাছে গেলে স্পষ্ট হয়, এই জায়গাটিই হোটেলের নোংরা পানির গোপন নিষ্কাশন কেন্দ্র।

হোটেলের পশ্চিম পাশে সড়কের নিচ দিয়ে টানা হয়েছে মোটা পাইপ। রাতের অন্ধকার নামলেই ওই পাইপ দিয়ে বর্জ্যপানি ঢালা হয় বালিয়াড়িতে। দীর্ঘদিনের জমে থাকা পানি ও আবর্জনার কারণে সেখানে তৈরি হয়েছে ছোটখাটো পুকুরের মতো একটি ডোবা- যেখানে মশা, মাছি, নানা পোকার উৎপাত নিত্যদিনের চিত্র।

বর্জ্য জমে থাকা ওই স্থানে এখন স্থায়ীভাবে জন্মেছে কচুগাছ। বলা চলে, দূষণের বুকে গজিয়ে উঠেছে কৃত্রিম কচুখেত।

কাজল নামের স্থানীয় এক দোকানদার বলেন, গভীর রাতে পানি ছাড়ে। তখন গন্ধে দাঁড়ানোই যায় না। পর্যটকেরাও নাকে কাপড় চেপে চলে। অনেকে মরা ইঁদুর থেকেও বিভিন্ন আবর্জনা ওই ডোবায় ফেলে।

আরেক বাসিন্দা নয়ন আব্দুল্লাহ বলেন, দিনের বেলায় পানি ছাড়ে না, কারণ দেখলে লোকজন ভিডিও করে। কিন্তু রাতে গোপনে পানি ঢালে। পানিটা সৈকতে গেলে যেন ছড়ানো না পড়ে, সে জন্যই নাকি ডোবা বানিয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের একাধিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, কক্সবাজারে বেশির ভাগ হোটেলেই নেই এসটিপি বা ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি)। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ সমুদ্রে নামছেন, পানির ধারে বসছেন- কিন্তু তাঁদের অজান্তে একই জায়গায় মিশে যাচ্ছে হোটেলগুলোর নোংরা পানি, সাবান-ডিটারজেন্ট, বাথরুম-কিচেন বর্জ্য।

বছরের পর বছর এই অবস্থার ফলে সমুদ্রের পানি, বালুচর, আশপাশের পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। পরিবেশবিদরা সতর্ক করে বলেছেন, এভাবে দূষণ চলতে থাকলে কক্সবাজারের জীববৈচিত্র্য, মাছের বংশবিস্তার, সামুদ্রিক প্রাণীর বাস্তুতন্ত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা একাধিক বৈঠকে এসটিপি বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করলেও বাস্তবায়নে নেই দৃশ্যমান উন্নতি। বরং প্রতি বছর বাড়ছে হোটেল–মোটেলের সংখ্যা- কিন্তু বাড়ছে না বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিকাঠামো।

দি সি-প্রিন্সেস হোটেলের বিরুদ্ধে বর্জ্য দূষণের অভিযোগ নতুন নয়।

এর আগে চলতি বছরের ৭ মার্চ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের অভিযানে হোটেলের ফ্রিজে পচা খাবার, নোংরা রান্নাঘর ও তেলাপোকার উপদ্রব পাওয়া গেলে প্রতিষ্ঠানটিকে তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

অভিযোগ আছে- হোটেলের নকশা, মালিকানা, রান্নাঘরের পরিচ্ছন্নতা, এসটিপি না থাকা- সব মিলিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা অনিয়মে জড়িয়ে আছে হোটেলটি।

হোটেলের পরিচালক কুতুব উদ্দিন বর্জ্যপানি সৈকতে পড়ার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি সরকারের সব ভ্যাট- ট্যাক্স দিই। কিন্তু কেউ আমাদের ড্রেন করে দেয়নি। এত বড় হোটেলের ময়লা কোথায় দেব?

প্রশ্ন করা হয়- ড্রেন না থাকলেই কি সমুদ্রে ময়লা ফেলতে হবে।

তিনি পাল্টা জবাব দেন, কক্সবাজারে কয়টা হোটেলে এসটিপি আছে, আগে দেখেন। পানি বের করার পথ নাই। আমি কী করব?

প্রশাসনের সূত্র বলছে, দুই মাস আগেই একই অপরাধে হোটেলটিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে মোবাইল কোর্ট। ভবিষ্যতে এমন কাজ না করার লিখিত অঙ্গীকারও নেয়া হয়।

জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আজিম খান বলেন, যদি আবারও একই কাজ করে থাকে, এবার কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতেই হবে।

কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন- জরিমানা হয়, অঙ্গীকার নেওয়া হয়- কিন্তু বাস্তবে কিছুই বদলায় না। দূষণ থামে না, বরং বেড়েই চলছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, কক্সবাজারের সমুদ্র শুধু পর্যটনের প্রাণ নয়- বরং দেশের সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের একটি বড় অংশের নির্ভরশীলতা এখানেই। অথচ বহুদিন ধরে হোটেল–মোটেলগুলোর বর্জ্যে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে এই সৈকত।

তাদের দাবি, অবিলম্বে সব হোটেলে এসটিপি বাধ্যতামূলক করা। ইসিএ এলাকায় বর্জ্য ফেলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা। নিয়মিত পরিবেশ মনিটরিং। দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি। অন্যথায়, সমুদ্রের প্রাণহানি, পরিবেশ ধ্বংস এবং পর্যটনের ভবিষ্যৎ- সবই ঝুঁকিতে পড়বে।

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন