

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইতালি পাঠানোর নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের এক সদস্য। প্রাণহানির ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপগামী বহু তরুণ সর্বস্ব হারিয়ে ফিরে আসছে বা নিখোঁজ হচ্ছে।
চক্রটির অন্যতম সদস্য হিসেবে অভিযুক্ত হয়েছেন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার বড়হর ইউনিয়নের গুয়াগাঁতী গ্রামের হাজী আব্দুস ছোবাহানের ছেলে শফিকুল ইসলাম।
লেখাপড়া না জানা শফিকুল ইসলাম এলাকায় গরুর ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ব্যবসায় লোকসানের পর প্রায় চার বছর আগে তিনি লিবিয়া যান। সেখানে গিয়ে তার যোগাযোগ হয় ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালি যাওয়ার মাফিয়া চক্রের সঙ্গে। এরপর থেকে তিনি হয়ে ওঠেন মানবপাচারকারী চক্রের একজন সক্রিয় সদস্য।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত এক বছরে শফিকুল ইসলামের মাধ্যমে অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ লিবিয়া হয়ে ইতালি পৌঁছেছেন। প্রতিটি যাত্রীর কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে গড়ে ২০ লাখ টাকা করে।
প্রতারিত যাত্রীর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইতালিগামী যাত্রী জানান, শফিকুল ইসলামের সঙ্গে তার ১৯ লাখ টাকায় চুক্তি হয়। প্রথমে ১০ লাখ টাকা শফিকুলের স্ত্রীকে দেওয়া হয়। পরে ওমরাহ ভিসার আড়ালে সৌদি আরব পাঠানো হয়। সেখানে চার দিন থাকার পর মিশর হয়ে লিবিয়ার বেনিনা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছানো হয়।
তিনি বলেন,লিবিয়ায় পৌঁছার পর শফিকুল আমাদের সবাইকে তার বাসায় রাখে। ১৫ দিন পর নিয়ে যায় বেনগাতি এলাকায় একটি ঘরে, যাকে তারা ‘গেমঘর’ বলে। ৪০ ফিট দৈর্ঘ্যের ঘরে ১৭০ জন যাত্রীকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়।ওজন কমানোর জন্য প্রতিদিন এক বেলা অল্প খাবার দেওয়া হতো, সাত দিন পর পর গোসলের অনুমতি মিলতো। আলো জ্বালাতে দেওয়া হতো না। এক মাস সেখানে ছিলাম একদিনও ঘুমাতে পারিনি।
তিনি আরও জানান, অসুস্থ হয়ে পড়ার পরও কাউকে চিকিৎসা নিতে দেয়নি । অবশেষে তাদের (১৭০ জন) একটি স্পিডবোটে তুলে দেওয়া হয় ভূমধ্যসাগরে। পরে ইতালিয়ান কোস্টগার্ড অসুস্থ অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে। ইতালি পর্যন্ত পৌঁছাতে তার ১৯ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, যা পুরোটা দেওয়া হয়েছে উল্লাপাড়ার দালাল শফিকুলের বাড়িতে। তিনি আরো জানান শফিকুলের সাথে চুক্তি হয়েছিল বিমানের মাধ্যমে ইতালি পাঠাবেন কিন্তু তা না করে মৃত্যু ঝুঁকিতে স্পিডবোটে ইতালি পাঠিয়েছেন।
তবে এ বিষয়ে শফিকুলের বাড়িতে গেলে তার বড়ভাই আব্দুস ছালাম প্রথমে তার ভাই ইতালি পাঠানোর কথা অস্বীকার করলেও পরে জানান শফিকুল লিবিয়া গেছে, পরিচিত যারা আছে তাদের কে ইতালি পাঠিয়েছেন। তিনি আরো জানান শফিকুল লিবিয়া থেকে ইতালিতে ভূমধ্যসাগর দিয়ে পৌঁছে দিয়ে থাকে এতে সে টাকা পায়।
স্থানীয়দের বক্তব্য গুয়াগাঁতী গ্রামের নুরুল ইসলাম বলেন, শফিকুল আগে গরুর ব্যবসা করতো। চার বছর আগে ঋণগ্রস্ত হয়ে লিবিয়া গেছে। এখন সে মানুষকে ইতালি পাঠায়। আমাদের এলাকা থেকেই দুজন গেছে, আরও দুজন বর্তমানে তার সংস্পর্শে আছে তাদের কেও ইতালি পাঠাবেন । এই পথে যাওয়া মানে জীবনের ঝুঁকি নেওয়া।
মানবপাচারের আইনি দিক বাংলাদেশের মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ অনুযায়ী প্রতারণা, প্রলোভন বা জোরপূর্বক কাউকে অন্য দেশে পাঠানো বা পাঠানোর চেষ্টা করা মানবপাচার অপরাধ।
এই আইনে বলা হয়েছে মানবপাচারের অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা আজীবন কারাদণ্ড, এবং সর্বনিম্ন ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া যেতে পারে।
ঢাকা সেইফ মাইগ্রেশন এবং উন্নয়ন কর্মী রিফিউজি এন্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট এর প্রকল্প পরিচালক মোঃ আরিফুল ইসলাম বলেন তিনি প্রায় ১২ বছর ধরে অভিবাসন ও দক্ষতা উন্নয়ন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন গ্রামের অনেক তরুণ দালালের প্রলোভনে পড়ে সমুদ্রপথে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে। অনেকে আর ফিরে আসে না। IOM এর তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি ১ থেকে ৯ জুন পর্যন্ত ৫৮৪০ জন বাংলাদেশী ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইতালি গেছেন। ২০২৪ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ২,৫০০-এর বেশি অভিবাসী প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের মধ্যে বাংলাদেশিও রয়েছেন। দালালরা ভিসা লাগবে না বলে প্রতারণা করে ১৯/২০ লাখ টাকা নেয়, আর তরুণরা মানবপাচারকারীর ফাঁদে পড়ে।
তিনি আরো জানান মানবপাচার প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ী এই অপরাধে আজীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। প্রশাসনের পাশাপাশি সবাইকে এসব দালাল চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।অবৈধ পথে বিদেশযাত্রা আত্মঘাতী উত্তরণের পথ একটাই, সচেতনতা ও বৈধ অভিবাসন। স্বপ্নের ইউরোপ নয়, নিরাপদ জীবনের জন্য বৈধ পথেই যাত্রা করুন।
অভিযোগ রয়েছে, লিবিয়ায় অবস্থানরত শফিকুল ইসলাম এখনো সক্রিয়ভাবে এই অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন জেলার মানুষকে ইতালি পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে সে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
সচেতন মহল বলছে, মানবপাচারের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ ঠেকাতে প্রশাসনের আরও কঠোর নজরদারি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জরুরি।
মন্তব্য করুন