

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


নভেম্বরের শুরুতেই শীতের আমেজ ভর করেছে দেশের পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারে। টানা গরম ও বৃষ্টি শেষে স্বচ্ছ আকাশ, মোলায়েম বাতাস আর তুলতুলে ঢেউ যেন ডাক দিচ্ছে ভ্রমণপিপাসু মানুষকে। শুক্রবারের সাপ্তাহিক ছুটির দিনে তাই সকালবেলাতেই পুরো সাগরতীর মুখর ছিল পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও প্রিয়জনের সান্নিধ্যে আসা পর্যটকদের পদচারণায়।
বাংলার উপকূল ছুঁয়ে বিস্তৃত পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। বছরের এই সময়টায় সাধারণত পর্যটন মৌসুমের শুরু হয়। অন্য বছরগুলোর তুলনায় এবার শুরুটা যেন একটু বেশি জমজমাট। সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি লাবণী, সুগন্ধা, কলাতলী ও হিমছড়ি পয়েন্টে ছিল মানুষের ঢল। রোদ্রের কোমল উষ্ণতা, ঢেউয়ের গর্জন আর মানুষের কোলাহলে যেন ফের প্রাণ ফিরে পেয়েছে পর্যটন নগরী।
শুক্রবার বেলা সাড়ে ১০টার দিকে লাবণী পয়েন্টে দেখা যায় ভোর থেকেই মানুষের আনাগোনা। ভিজে বালুচরে শিশুরা ছোটাছুটি করছে, কেউ আবার হাতে বালতি-খুন্তি নিয়ে বালু দিয়ে বানাচ্ছে ছোট্ট স্বপ্নের দুর্গ। একটু দূরেই তরুণ-তরুণীরা ছবি তুলতে ব্যস্ত। সেলফি স্টিক হাতে কেউ দাঁড়িয়ে আছে ঢেউয়ের মুখে, কেউ নেমে গেছেন কোমর পর্যন্ত পানিতে।
ঢাকার কাওরানবাজার থেকে পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রায়হান কবির বলেন, অনেক দিন পর এমন সুন্দর আবহাওয়া পেলাম। বাচ্চারা তো আনন্দে আত্মহারা। ঢেউয়ের আওয়াজে মনে হচ্ছে সব ক্লান্তি যেন ধুয়ে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম থেকে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী স্নিগ্ধা। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ক্লাস, পরীক্ষা আর ব্যস্ত সময় কাটানোর পর একটু মুক্ত হাওয়া নিতে এসেছি। কক্সবাজারের সৌন্দর্য যতবারই দেখি, ততবারই নতুন লাগে।
কক্সবাজারে মৌসুম শুরু মানেই হোটেল-মোটেল ব্যবসায় কর্মচাঞ্চল্যের ছাপ। রাজনৈতিক সংকট পরবর্তী ধাক্কা কাটিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানো এই পর্যটনখাত নতুন করে আশাবাদী। মৌসুমের শুরুতেই বুকিং বাড়তে থাকায় হাসি ফুটেছে হোটেল মালিকদের মুখে।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল কাশেম বলেন, গত দুই মাস পর্যটক কম ছিল। এখন ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। শুক্রবার থেকেই বুকিং বেড়েছে। অনেকে আগাম বুকিং দিচ্ছেন নভেম্বর-ডিসেম্বরের তারিখে। যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে মৌসুমটা ভালো যাবে।
হোটেল ওশান প্যরাডাইজ পিআরও সায়ীদ আলমগীর জানান, শীত মৌসুম আমাদের জন্য প্রধান সময়। এই বছর এখন পর্যন্ত বুকিং প্রবাহ ভালো। পর্যটকরাই আমাদের প্রাণ, তারা ফিরছেন- এটাই সবচেয়ে আনন্দের।
পর্যটকদের নিরাপত্তায় সমুদ্রসৈকতে ট্যুরিস্ট পুলিশ ও লাইফগার্ডদের টহল রয়েছে জোরদার। বালিয়াড়িতে দাঁড়িয়ে লাইফগার্ডদের সিটি বাজানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝেই- যারা ঢেউয়ের বেশি দিকে যাচ্ছেন, তাদের ফের ডেকে আনা হচ্ছে।
সৈকতে দায়িত্বে থাকা লাইফগার্ড মোহাম্মদ হালিম বলেন, ঢেউ এখন ভালো। তবে মাঝে মধ্যে রিপকারেন্ট দেখা দেয়। তাই পর্যটকদের সবসময় সতর্ক হতে হবে। আমরা হুইসেল ও মাইকিং করে বার্তা দিচ্ছি।
কক্সবাজার শুধু পর্যটনের জন্য নয়, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যেরও অন্যতম স্থান। তাই বাজার, তীরবর্তী এলাকা ও ঝাউবনের পাশে পরিচ্ছন্নতার বিষয়েও দৃষ্টি দিতে হবে বলে মনে করেন পরিবেশকর্মীরা।
পরিবেশ-সচেতন সংগঠন ‘সি-সেভার্স’-এর সদস্য রিমা চৌধুরী বলেন, সৈকত আবারও প্রাণ ফিরে পেয়েছে, এটা আনন্দের। কিন্তু আমরা চাই পর্যটকরা যেন পরিবেশ সচেতন হন। বিশেষত প্লাস্টিকজাত বর্জ্য যেন কেউ এখানে না ফেলে। কক্সবাজার শুধু সুখের স্মৃতি দেয় না, প্রকৃতি-সংরক্ষণের দায়িত্বও স্মরণ করিয়ে দেয়।
পর্যটন মৌসুমে স্থানীয় ব্যবসা যেমন চাঙ্গা হয়, তেমনি বাড়ে কর্মসংস্থানের সুযোগও। বিচের পাশে ডাব বিক্রি করা আবদুল কাদের বলেন, অফ-মৌসুমে আয় কম ছিল। এখন পর্যটক বেড়েছে, বিক্রিও ভালো হচ্ছে। আমরা চাই সারা মৌসুমজুড়ে এমন ভিড় থাকুক।
পর্যটনসংশ্লিষ্টদের মতে, টেকসই ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন আছে। সড়ক যোগাযোগ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জনসচেতনতা, এবং জরুরি চিকিৎসা সেবাসহ কিছু দিক আরও শক্তিশালী করা দরকার।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু মোর্শদ চৌধুরী খোকা বলেন, কক্সবাজারের সামর্থ্য অনেক। সরকারের পরিকল্পনা আছে, উন্নয়নও হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে হলে সৈকত ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতায় আরও সমন্বয় দরকার। পর্যটকদের অভিজ্ঞতা যত উন্নত হবে, তারা ততবার ফিরে আসবেন।
শীতের আগমনী বার্তা মিলতেই যে ভিড় শুরু হলো, তা জারি থাকলে পর্যটন অর্থনীতি শক্তিশালী হবে- এমন প্রত্যাশা বিভিন্ন পক্ষের। কোভিডের পর অর্থনীতির চাপ কাটিয়ে ওঠা কক্সবাজারের জন্য এ মৌসুম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে কক্সবাজারে ভ্রমণে আসা পর্যটকদের অনেকে বলছেন, এখানে শুধু সাগর নয়- ঝাউবন, পাহাড়, মেরিন ড্রাইভ, হিমছড়ি, ইনানী, পাহাড়ি জলপ্রপাতসহ অসংখ্য আকর্ষণ রয়েছে। সময় নিয়ে এসব জায়গাও দেখতে চান অনেকেই।
চট্টগ্রামের বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা ইয়াসিন আরাফাত বলেন, শুধু সৈকত নয়, আমরা মেরিন ড্রাইভ ধরে হিমছড়িতেও যাব। সারা বছর এমন সুযোগ মেলে না। তাই চেষ্টা করছি প্রিয়জনদের সঙ্গে সময়টা উপভোগ করতে।
ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। সমুদ্রের স্বভাব কখনো কখনো অপ্রত্যাশিত হয়, তাই আমরা চাই সবাই নির্ধারিত সীমায় থাকুক। লাইফগার্ড দলের সদস্যরা সার্বক্ষণিক সতর্ক রয়েছে।
মন্তব্য করুন