সোমবার
২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ৭ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সোমবার
২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ৭ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশের যে বিমানঘাঁটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে

এনপিবিনিউজ ডেস্ক
প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:১৫ পিএম আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:১৬ পিএম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ফেনীর বিমান ঘাঁটি
expand
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ফেনীর বিমান ঘাঁটি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ফেনী জেলা যে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের অংশ তা আজ অনেকেরই অজানা। ১৯৪৪ সালে নির্মিত ফেনী বিমানঘাঁটি ছিল ব্রিটিশ ও মার্কিন মিত্রবাহিনীর একটি বড় সামরিক কেন্দ্র, যার মূল লক্ষ্য ছিল বার্মা ফ্রন্টে জাপানি বাহিনীর অগ্রযাত্রা প্রতিহত করা।

ফেনী শহরের কেন্দ্রস্থল ট্রাংক রোড থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে উত্তর বিরিঞ্চি এলাকায় এই বিমানঘাঁটির মূল অংশ ছিল। বিরিঞ্চির পাশাপাশি সুলতানপুর, বারাহিপুর, মজলিশপুর, ধর্মপুর ও দেবীপুর এই কয়েকটি এলাকায় ছড়িয়ে ছিল প্রায় সাড়ে তিন শ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা বিমানঘাঁটির বিভিন্ন স্থাপনা। বর্তমানে এসব স্থানে বসতবাড়ি, ফসলি জমি এবং কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

আজও উত্তর বিরিঞ্চি এলাকায় পুরোনো ইটের তৈরি একটি দীর্ঘ রাস্তা চোখে পড়ে, যা একসময় যুদ্ধবিমানের রানওয়ে ছিল। বাড়িঘর ও খেতের মাঝখানে লুকিয়ে থাকা এই রাস্তা সাধারণ মানুষের কাছে এখন আর আলাদা করে চোখে পড়ে না।

যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর তথ্যমতে, ১৯৪৪ সালে ফেনী বিমানঘাঁটি নির্মাণ করে যুক্তরাষ্ট্র আর্মি এয়ার ফোর্স। এটি ছিল তাদের দশম বিমানবাহিনীর অধীন দ্বাদশ বোমারু দলের প্রধান ঘাঁটি। ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ১৯৪৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত এখান থেকে নিয়মিত যুদ্ধ অভিযান পরিচালিত হয়।

এই ঘাঁটি থেকে মাঝারি পাল্লার বোমারু বিমান দিয়ে বার্মায় জাপানি সামরিক অবস্থানে হামলা চালানো হতো। একই সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা ব্রিটিশ চতুর্দশ সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র, গোলাবারুদ ও রসদ সরবরাহ করা হতো আকাশপথে। ফেনী বিমানঘাঁটি শুধু আক্রমণ কেন্দ্রই নয়, বরং সামরিক যোগাযোগ, বিমান রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।

কৌশলগত দিক থেকে বার্মা সীমান্তের কাছাকাছি হলেও ফেনীর অবস্থান ছিল তুলনামূলক নিরাপদ, ফলে এখান থেকে অভিযান পরিচালনা করা মিত্রবাহিনীর জন্য সুবিধাজনক ছিল।

প্রায় আট দশক আগে এই এলাকায় বসবাসকারী মানুষের কাছে যুদ্ধ ছিল নিত্যদিনের বাস্তবতা। বিমান ওঠানামা, বিমান বিধ্বংসী কামানের বিকট শব্দ এবং হঠাৎ হঠাৎ সাইরেন সবই ছিল দৈনন্দিন জীবনের অংশ। অনেক পরিবারকে নিরাপত্তার কারণে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছিল।

লেখক ও বিচারপতি কাজী এবাদুল হক এবং সাংবাদিক এবিএম মূসাসহ বিভিন্ন লেখকের স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে, কীভাবে ফেনীতে যুদ্ধ মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। ১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসে ফেনী শহরে জাপানি বিমান হামলার ঘটনাও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে।

যুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালে বিমানঘাঁটির সামরিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এরপর দীর্ঘদিন অবহেলা ও দখলের কারণে প্রায় সব স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমানে উত্তর বিরিঞ্চি এলাকায় ঝোপঝাড়ে ঢাকা প্রায় ২০ ফুট উঁচু দুটি দেয়াল এখনো দাঁড়িয়ে আছে, যা একসময় বিমান রাখার হ্যাঙ্গারের অংশ ছিল।

স্থানীয় বাসিন্দা ও ইতিহাসসচেতন ব্যক্তিদের মতে, এই দেয়াল দুটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে এগুলোও হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

ফেনী বিমানঘাঁটি শুধু একটি পরিত্যক্ত স্থাপনা নয় এটি বাংলাদেশের মাটিতে সংঘটিত বৈশ্বিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। যথাযথ সংরক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে এই স্থানকে ঐতিহাসিক ঐতিহ্য হিসেবে তুলে ধরা গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারবে, কীভাবে ফেনী একসময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতিপথে ভূমিকা রেখেছিল।

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

X