

সরকারি সার আত্মসাৎ করে কালোবাজারে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেড ও ডেইলি ট্রেডিং কোং নামক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। সরকারের ভর্তুকি দেওয়া সার বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কালোবাজারে বিক্রি করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি।
স্থানীয় সার ব্যবসায়ীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত রোববার (২৩ নভেম্বর) দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে যশোর জেলার অভয়নগর থানাধীন সার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির নিচতলায় অবস্থিত মেসার্স বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেড ও ডেইলি ট্রেডিং কোং নামক অফিসে যশোর জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) অফিসার ইনচার্জের নেতৃত্বে এসআই বাবলা দাস, এসআই মোঃ কামাল হোসেন অভিযান চালিয়ে ৪ হাজার ৮৪০ বস্তা সারসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। যার আনুমানিক মূল্য দুই কোটি বাহান্ন লক্ষ ঊনানব্বই হাজার টাকা।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন বঙ্গ ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক চাঁদপুরের শাহরাস্তি থানার বারুলিয়া গ্রামের সুমন মজুমদার (৩৫), বঙ্গ ট্রেডার্সের উপ-ব্যবস্থাপক চট্টগ্রামের টাইগারপাস বটতলা রেলওয়ে কলোনি এলাকার বাবুল দাস (৩৬) এবং বঙ্গ ট্রেডার্সের সহকারী ব্যবস্থাপক নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার উইলসন রোডের বাসিন্দা মাসুম বিল্লাহ (৪২)। গতকাল সোমবার তাদেরকে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে যশোর জেলার অভয়নগর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলা নং—১১(১১)২৫, তারিখ ২৩/১১/২০২৫ ইং।
বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেড বিএডিসির সার সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। ডিবি পুলিশ জানায়, যশোর জেলার অভয়নগর থানাধীন সর্দার জুট মিল ঘাট, মক্কা ঘাট এবং বড়বাড়ি ঘাট থেকে নীলফামারী, রংপুর, রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, পাবনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, রাজবাড়ীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার সরকারি (বিএডিসি) গুদাউনের সার পৌঁছানোর নামে কালোবাজারে বিক্রি করছে সার পরিবহন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেড ও ডেইলি ট্রেডিং কোম্পানি।
বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেড ও ডেইলি ট্রেডিং কোম্পানির অফিসকক্ষে বাবুল দাসের ব্যবহৃত ব্যক্তিগত টেবিলের ড্রয়ার থেকে নগদ ২২ লাখ ২৪ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। কালোবাজারে সরকারি সার বিক্রির অবশিষ্ট টাকা তাদের কোম্পানি বঙ্গ ট্রেডার্সের অ্যাকাউন্টে জমা দিয়েছে বলে তারা পুলিশকে জানিয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃতরা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেড ও ডেইলি ট্রেডিং কোম্পানির মালিক একজনই। মালিকের নাম মোঃ জসিম উদ্দিন। তাদের মতো আরও ৪২ জন কর্মকর্তা রয়েছে, যারা প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিভিন্ন জেলায় কালোবাজারে সরকারি সার বিক্রি করে আসছে।
এর আগে এই চক্রটি গত ৮ নভেম্বর যশোর থেকে গভীর রাতে চুয়াডাঙ্গা জেলার সদর উপজেলার গোষ্টবিহার গ্রামে ২০ টনের একটি ট্রাক সার নিয়ে কালোবাজারে বিক্রির সময় উপজেলা কৃষি বিভাগের হাতে ধরা পড়ে। ওই সারবোঝাই ট্রাকটি স্থানীয় ব্যবসায়ী শামীম রেজার গুদামে যাচ্ছিল। পরে ব্যবসায়ী শামীম রেজাকে এক মাসের কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা করে স্থানীয় ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এই চক্রটি দেশের ঘাটগুলোতে জাহাজ থেকে নামানো সরকারি সার প্রতিনিয়তই কালোবাজারে বিক্রি করছে বলে ডিবি পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে। তারা সরকারি সার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কাগজে-কলমে সংরক্ষণ দেখিয়ে গুদামে সরবরাহের কথা বলে ট্রাকে করে নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীদের কাছে কম মূল্যে বিক্রি করে থাকে।
এদিকে গত ১১ নভেম্বর (মঙ্গলবার) পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার দিয়ার পাড়া গ্রামে সরকারি সার কালোবাজারে বিক্রির সময় বিসিআইসি ডিলার সেলিম হোসেনকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
গত ৯ অক্টোবর সকালে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলায় বিএডিসি ডিলারের সার কালোবাজারে বিক্রি করার সময় বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেডের একজন কর্মকর্তাকে আটক করেছে জনতা। পরে তাকে পুলিশে সোপর্দ করে।
এই চক্রটি গত ৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার রাতে বগুড়া জেলার ধুনট উপজেলার রামপুরা এলাকায় পাচারের উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি ট্রাক সার কালোবাজারে বিক্রির সময় স্থানীয় লাবনী ট্রেডার্সের দায়িত্বে থাকা মেসার্স সজিব ট্রেডার্সের মালিক সাইদুল ইসলাম জনতার হাতে আটক হন। সেখান থেকে কালোবাজারে বিক্রেতা বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেডের কর্মকর্তা পরিমল বর্মন পালিয়ে যান। পরে খবর পেয়ে সদর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে সারগুলো জব্দ করে থানায় নিয়ে যায়।
গত ১২ নভেম্বর (বুধবার) দিবাগত রাত সাড়ে ৯টার দিকে রংপুরের তারাগঞ্জে অবৈধভাবে ডিএপি সার পাচারের সময় জনতার হাতে আটক হন বঙ্গ ট্রেডার্সের দুইজন কর্মকর্তা। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে তাদের ৮০ হাজার টাকা জরিমানা এবং এক হাজার দুইশত বস্তা ডিএপি সার বাজেয়াপ্ত করা হয়।
এ ছাড়া গত ১৬ নভেম্বর রংপুর জেলার তারাগঞ্জ বাজারের অগ্রণী ব্যাংক সংলগ্ন এলাকায় ৬০০ বস্তা ডিএপি সার নীলফামারীর জলঢাকায় পাচারের চেষ্টা করছিল বঙ্গ ট্রেডার্সের একজন কর্মকর্তা। স্থানীয়দের সন্দেহ হলে তারা মিনি ট্রাক আটক করে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবেল রানা। তিনি পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলেই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। এ সময় বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেডের কর্মকর্তা মিজানুর রহমান পালিয়ে যান।
চলতি বছর জিটুজিতে (সরকার টু সরকার) আমদানীকৃত ১৪ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার সার পরিবহনের জন্য কোটি কোটি টাকা কমিশনের বিনিময়ে বঙ্গ ট্রেডার্স নামক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিয়ে এখন বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)। এ ছাড়া এই চক্রের হাত থেকেও রেহাই পায়নি বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি)।
মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কর্তৃক বিএডিসিতে গঠিত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে টেন্ডার জালিয়াতির মাধ্যমে বিদেশ থেকে আমদানীকৃত প্রায় ১৪ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট), ডিএপি (ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট) এবং এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) সার পরিবহনের জন্য এই দুর্নীতিবাদী কালোবাজারি প্রতিষ্ঠানকে এককভাবে ২৮ থেকে ২৯টি টেন্ডারের মাধ্যমে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়।
কার্যাদেশ গ্রহণের পর থেকেই বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেড ও ডেইলি ট্রেডিং কোম্পানির মালিক মোঃ জসিম উদ্দিনের সাথে বিএডিসি বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো ফোনই রিসিভ করছেন না। এ ছাড়া গত ২ নভেম্বর বিএডিসি থেকে বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেড ও ডেইলি ট্রেডিং কোম্পানির জিএম মোঃ বাহাউদ্দিনকে তার মোবাইলে কল করা হলে মোবাইল ফোন রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে গত ২০ নভেম্বর বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেড ও ডেইলি ট্রেডিং কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার মোঃ বাহাউদ্দিন মোবাইল ফোন ব্যাক করে একজন কর্মকর্তাকে জানান—লোডপোর্টে জাহাজ লে-ক্যানের বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের সাথে তাদের মালিকের কথা হয়েছে। জাহাজ পাওয়া সাপেক্ষে তারা লোডপোর্টে জাহাজ লে-ক্যান করবে। এ ছাড়া তাদের বিকল্প কিছুই করার নেই।
এদিকে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর নরসিংদী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কামরুল আশরাফ খান পোটনের পথ অবলম্বন করেছে বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেড ও ডেইলি ট্রেডিং কোম্পানির মালিক মোঃ জসিম উদ্দিন। তারা চলতি বছর জিটুজিতে আমদানীকৃত ১৪ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার সার পরিবহনের জন্য কোটি কোটি টাকা ঘুষ প্রদান করে বঙ্গ ট্রেডার্স নামক প্রতিষ্ঠানের নামে মন্ত্রণালয় কর্তৃক সৃষ্ট এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কার্যাদেশ গ্রহণ করে দেশে সারের এই মহাসংকট সৃষ্টি করে সরকারকে ইচ্ছাকৃতভাবে বেকায়দায় ফেলেছে। সারের সংকট সৃষ্টির কারণে এবার দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। যার কারণে দেশের প্রান্তিক চাষীরা এবার সময়মতো সার পাচ্ছেন না।
এ সব অভিযোগের বিষয়ে জানতে মেসার্স বঙ্গ ট্রেডার্সের জেনারেল ম্যানেজার মোঃ বাহাউদ্দিনকে মোবাইলে কল করা হলে তিনি ধরেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
মন্তব্য করুন