

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


বাংলাদেশে ইলিশ এখন সোনার হরিণ। স্থানীয় বাজারে দাম এতটাই বেড়েছে যে সাধারণ মানুষ একে ধরাছোঁয়ার বাইরে মনে করছে।
অথচ বিস্ময়করভাবে ভারতে রপ্তানির ক্ষেত্রে দাম রাখা হয়েছে তুলনামূলক কম। দেশের বাজারে যেখানে প্রতি কেজি ইলিশ ১৯০০–২০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, সেখানে ভারতে রপ্তানি করা হচ্ছে ১৫২৫ টাকায়। এই বৈপরীত্য নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন—কীভাবে সম্ভব এমন রপ্তানি?
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইলিশের আসল গন্তব্য কেবল ভারত নয়, বরং সেখান থেকে পুনঃরপ্তানির মাধ্যমে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যসহ উন্নত দেশগুলোতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ইলিশ।
ভারতকে কার্যত ট্রানজিট রুট বানিয়ে এই ব্যবসা চালাচ্ছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট, যার সঙ্গে দুই দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী জড়িত। শুধু অনুমোদিত মৌসুমেই নয়, বছরের প্রায় সময় জুড়েই চলে সীমান্তপথে ইলিশ পাচার।
দাম নির্ধারণ ও রপ্তানির অনুমতি
২০০৭ সাল থেকে বিদেশে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ সরকার, স্থানীয় বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণ ও সহজলভ্যতার স্বার্থে।
তবে প্রতিবছর দুর্গাপূজার সময় ভারত ব্যতিক্রম হিসেবে রপ্তানির অনুমতি পেয়ে আসছে। সেক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত দামে রপ্তানি হয়, যা দেশের বাজারদরের তুলনায় কম থাকে।
এ বছরও ১২০০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। দাম ধরা হয়েছে প্রতি কেজি ১৫২৫ টাকা (সাড়ে ১২ ডলার)। কিন্তু এ ঘোষণার সময় থেকেই দেখা দেয় সমালোচনা, কারণ স্থানীয় বাজারে ওই সাইজের ইলিশের দাম তখনই ১৫৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। বরফ, প্যাকেজিং ও পরিবহন খরচ ধরলে রপ্তানির খরচ দাঁড়াচ্ছিল প্রায় ১৭০০ টাকা। ফলে ব্যবসায়ীরা কীভাবে কম দামে রপ্তানি করছেন, সেটি রহস্য হয়ে দাঁড়ায়।
সরকার দাম বাড়ায়নি, আবার ব্যবসায়ীরাও কোনো লিখিত আপত্তি জানাননি। বরং অনুমতি মেলে সঙ্গে সঙ্গেই ৩৭টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান চালান পাঠানো শুরু করে। প্রথম তিন দিনেই আখাউড়া ও বেনাপোল বন্দর দিয়ে প্রায় ৭০ টন ইলিশ ভারত প্রবেশ করে।
স্থানীয় বাজারের প্রভাব
রপ্তানির পর দেশে ইলিশের দাম আরও চড়া হয়। বরিশালের মোকামে এলসি সাইজ ইলিশের পাইকারি দর উঠে যায় ১৯০০ টাকায়। মোকামের ব্যবসায়ীরা অবাক হয়ে বলেন, রপ্তানিকারকরা ১৮৫০–১৯০০ টাকায় মাছ কিনে কীভাবে ১৫২৫ টাকায় রপ্তানি করছেন? ধারণা হয়েছিল, ভারতীয় আমদানিকারকদের কাছ থেকে গোপনে অতিরিক্ত দাম নেওয়া হচ্ছে এবং হুন্ডির মাধ্যমে টাকা ফেরত আসছে।
কিন্তু কলকাতার হাওড়া বাজারে ইলিশ বিক্রি হচ্ছিল ১৫০০–১৬০০ রুপি দরে (বাংলাদেশি মুদ্রায় ২১০০–২২০০ টাকা), যা বাস্তবে লোকসান ছাড়া সম্ভব নয়। অনুসন্ধানে বের হয়, এই মাছের উল্লেখযোগ্য অংশ ভারতে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি না হয়ে তৃতীয় দেশে চলে যাচ্ছে।
ভারত হয়ে পাচারের কৌশল
মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি রেস্তোরাঁয় সারা বছর ইলিশ পাওয়া যায়। কুয়ালালামপুরের বুকিত বিনতাং এলাকায় হোটেল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সরাসরি বাংলাদেশ থেকে ইলিশ আসে না, আসে ভারত হয়ে। ভারতীয় লাইসেন্সে ফ্রোজেন ইলিশ আসে, কিন্তু চুক্তি হয় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। একইভাবে সিঙ্গাপুরেও ইলিশ পৌঁছে যায় ভারতীয় রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে।
কলকাতার একাধিক ব্যবসায়ীও স্বীকার করেছেন, বছরের বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ থেকে চোরাপথে ইলিশ আসে। সেই ইলিশের বড় অংশ আবার এখান থেকে পুনঃরপ্তানি হয় অন্য দেশে। মূল দালালি করেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাই, ভারতীয় রপ্তানি লাইসেন্স শুধু আড়ালের কাজ করে।
প্রভাবশালী রপ্তানিকারক ও সিন্ডিকেট
এই পুরো প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে গঠিত শক্তিশালী সিন্ডিকেট। জানা গেছে, বাংলাদেশের একাধিক রপ্তানিকারকের কলকাতায় বাড়ি, আড়ত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বরিশালের নীরব হোসেন টুটুল, পাবনার সেভেন স্টার গ্রুপ ও কেবিসি নামের আরেক রপ্তানিকারক কলকাতার বাজারে বিশেষ প্রভাবশালী। ভারতীয় আত্মীয়স্বজনের নামে লাইসেন্স নিয়ে তারা বাংলাদেশি ইলিশকে ‘ভারতীয় রপ্তানি’ বানিয়ে বিশ্ববাজারে পাঠাচ্ছেন।
ভারতের মাছ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণেই এসব কাজ সহজে সম্পন্ন হয়। স্থানীয় সংবাদকর্মী ও বাজারের ব্যবসায়ীরাও নিশ্চিত করেছেন, এই সিন্ডিকেট বহুদিন ধরে কলকাতার ইলিশ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
সরকারি ও সংগঠনের অবস্থান
রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হননি। ভারতের ফিশ ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনও পুনঃরপ্তানির অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সংগঠন ফিশ এক্সপোর্টার্স অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অবশ্য বলছে, দেশের বাজারদরের চেয়ে কম দামে রপ্তানি হওয়াটা অস্বাভাবিক।
 সর্বশেষ খবর পেতে  Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
    
    
    সর্বশেষ খবর পেতে  Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
    
মন্তব্য করুন
