

সম্পাদকঃ মোঃ আল হাদী
৪১৬ তোপখানা রোড, শিশু কল্যাণ পরিষদ, ঢাকা, বাংলাদেশ
টেলিফোনঃ +৮৮(০২) ৫৮৩১২৯৫৮, ৫৮৩১২৮২২ফেক্সঃ ৫৮৩১২৯৮১[email protected]


বাংলাদেশের শিক্ষা ও বিজ্ঞান অঙ্গনে আরেকটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন ঘটেছে। দেশের খ্যাতনামা পরমাণু পদার্থবিদ, শিক্ষাবিদ ও বহুমাত্রিক চিন্তাবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শমশের আলী ২ আগস্ট রোববার গভীর রাতে পরলোকগমন করেছেন।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিজ্ঞানের প্রসার, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রশাসনে তাঁর অসামান্য অবদান তাঁকে এক গভীর শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আজ তাঁর জীবন ও কর্মের দিকে ফিরে তাকালে স্পষ্ট হয় — তিনি ছিলেন জ্ঞানচর্চা ও মানবকল্যাণের বিরল দৃষ্টান্ত।
১৯৩৭ সালের নভেম্বর মাসে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় জন্ম নেওয়া শমশের আলীর শৈশব কেটেছে চুয়াডাঙ্গা, রানাঘাট ও যশোরে। অসামান্য মেধাবী এই ছাত্র স্কুল ও কলেজজীবনে সব পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে ১৯৫৬ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট সম্পন্ন করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে; ১৯৫৯ সালে স্নাতক এবং ১৯৬০ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। উচ্চতর গবেষণার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁকে ১৯৬১ সালে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে কিংবদন্তি পদার্থবিদদের তত্ত্বাবধানে গবেষণা সম্পন্ন করে ১৯৬৫ সালে তিনি তাত্ত্বিক পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি অর্জন করেন।
দেশে ফিরে তিনি পাকিস্তান (পরবর্তীতে বাংলাদেশ) পরমাণু শক্তি কমিশনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দীর্ঘ ২১ বছর ধরে (১৯৬১–১৯৮২) গবেষণা, পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব দিয়ে দেশের পারমাণবিক গবেষণার ভিত মজবুত করেন। ১৯৭০ সালে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে ঢাকা পরমাণু শক্তি কেন্দ্রের পরিচালক হন, যা ছিল যুগান্তকারী অর্জন। তাঁর মেধা ও গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ১৯৭৩ সালে অনারারি প্রফেসরের মর্যাদা ও ১৯৭৪ সালে হরি প্রসন্ন রায় স্বর্ণপদক প্রদান করে।
১৯৮২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং দুই যুগেরও বেশি সময় শিক্ষকতা করে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে গবেষণায় অনুপ্রাণিত করেন। জটিল বৈজ্ঞানিক ধারণা সহজভাবে ব্যাখ্যা করার দক্ষতার জন্য তিনি ছিলেন শিক্ষার্থীদের কাছে প্রিয় ও সম্মানিত শিক্ষক।
শিক্ষা প্রশাসনে তাঁর দূরদর্শিতা ছিল অসাধারণ। দেশে ওপেন অ্যান্ড ডিস্টেন্স লার্নিং পদ্ধতির ধারণা তিনিই প্রথম উপস্থাপন করেন এবং ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য হিসেবে সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেন। পরে সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির জন্মলগ্নে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে দ্রুত বিকাশমান উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেন।
২০০৪–২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তিনি জাতীয় গবেষণার গতিশীলতা বাড়ান এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ করেন।
তাঁর কর্মজীবন শুধু গবেষণা ও প্রশাসনে সীমাবদ্ধ ছিল না; তিনি ছিলেন বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে এক অনন্য মুখপাত্র। ষাটের দশক থেকেই তিনি টেলিভিশন ও রেডিও অনুষ্ঠানে বিজ্ঞানচর্চা সহজবোধ্য ভাষায় উপস্থাপন করতেন। প্রায় পাঁচ শতাধিক গণমাধ্যম উপস্থাপনায় তিনি বিজ্ঞানকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। একইসঙ্গে বিজ্ঞান ও ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে গভীর গবেষণা করে ‘পবিত্র কোরআনে বৈজ্ঞানিক ইঙ্গিত’ ও ‘Muslim Contribution to Science and Technology’-এর মতো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
তাঁর লেখা বহু গ্রন্থে জটিল গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান সহজভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যেমন Making Math Fun, Brain Twister, Aladdin’s Real Lamp ইত্যাদি। বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটানোর জন্য তিনি ইতালিভিত্তিক TWNSO-এর Public Understanding of Science পুরস্কার পান ১৯৯০ সালে।
ড. শমশের আলী জীবদ্দশায় বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা অর্জন করেছেন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হরি প্রসন্ন রায় স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির স্বর্ণপদক, খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ স্বর্ণপদক, মাদার তেরেসা স্বর্ণপদকসহ অসংখ্য সম্মান তাঁর ঝুলিতে জমা হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি TWAS-এর ফেলো হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।
তিনি ছিলেন এমন এক মনীষী যিনি জ্ঞানচর্চাকে মানবকল্যাণের সঙ্গে যুক্ত করে দেখিয়েছেন, কীভাবে শিক্ষা ও গবেষণা সমাজকে বদলে দিতে পারে। তাঁর প্রয়াণে দেশ এক আলোকবর্তিকাকে হারাল। কিন্তু তিনি রেখে গেছেন প্রতিষ্ঠান, দৃষ্টিভঙ্গি, অনুপ্রেরণা — যা নতুন প্রজন্মকে পথ দেখাতে থাকবে যুগের পর যুগ।
প্রিয় শিক্ষক, বিজ্ঞান ও শিক্ষার আকাশে আপনার আলো চিরকাল দীপ্তি ছড়াবে। গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি আপনাকে।
লেখক: উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন