

নাম পরিচয় যেনো বিলাসিতা। শেষ কবে গায়ে কাপড় জুটেছে বলা মুশকিল। শরীরে বয়সের চাপের সঙ্গে নানান রোগবালাইয়ের সংযুক্তির ছাপ স্পষ্ট। মৌলিক অধিকার তো দূরের কথা, এ যেনো নামে মাত্র বেঁচে থাকা। আসলে, জন্মেছিলো বলেই মৃত্যু আলিঙ্গনের অপেক্ষা। এই নির্মম বর্ণনা- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার নীলক্ষেত সড়কের ফুটপাতে শুয়ে-বসে থাকা এক ষাটোর্ধ্ব মানুষের। যিনি সমাজের চোখে ‘অদৃশ্য মানব’। মানবেতর জীবনযাপন সীমার নীচে বসবাস করা এমন মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়।
নির্দিষ্ট থাকার জায়গা না থাকায় সবখানেই বসবাস তাদের; তবে, উচ্চবিত্ত এলাকাগুলোতে দেখা মেলে না। কখনও গাছের ছায়ায়, কখনও জলাধার বা প্রতিষ্ঠানের প্রবেশ পথে এদের বেশি ভিড়। রাজধানীর শাহবাগ মোড়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, নীলক্ষেত, আজিমপুর, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এদের উপস্থিতি বেশি। সড়কের বসবাস করতে করতেই এদের প্রাণ ত্যাগও ঘটে পথেই। যারা মারা যাচ্ছেন তাদের সবাই পরিচয়হীন, আইনের কথা ‘অজ্ঞাত’।
সড়কে সড়কে বসবাস করা একাধিক ব্যক্তি মারা যাচ্ছে প্রতি সপ্তাহে। যাদের প্রায় সবাই মানবেতর জীবনযাপন ও অসুস্থতা বা শারীরিক দুর্বলতায় ভোগা ব্যক্তি। শরীরে রোগজীবাণু নিয়ে মোড়ে মোড়ে ধুঁকতে ধুঁকতে মৃত্যুর কোলে ঢেলে পড়ছে।
শাহবাগ থানার পুলিশ কনস্টেবল বিএল হোসেন জানান, চলতি অক্টোবর মাসেই থানাধীন এলাকা থেকে ৯ জনের মরদের উদ্ধার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৩ জন নারী রয়েছেন। মৃতদের বেশিরভাগ বয়স্ক ও রোগাক্রান্ত। অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ হাসপাতালে নিলে এদের মৃত ঘোষণা করা হয়।
থানার প্রতিনিধি হয়ে মর্গে সংশ্লিষ্ট কাজ করা এই পুলিশ সদস্য আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পয়েন্টে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও রমনা পার্ক এলাকায়, জাতীয় ঈদগাহ মাঠ এলাকা ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সংলগ্ন ফুটপাত থেকে এসব মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ময়নাতদন্তের পর ডিএনএ নমুনা রেখে সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে মরদেহ দাফন করা হয় অজ্ঞাত পরিচয়ে। অনেক সময় এসব বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে থাকে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম।
রাজধানীজুড়েই চোখে পড়ে ফুটপাত, ফুটওভারসহ বিভিন্ন স্থাপনার সামনে বা নীচে বসবাস করছে ছিন্নমূল মানুষ। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় রয়েছে নারী এবং শিশু। সমাজে এরা অদৃশ্য মানুষ, যেকারণে মৌলিক অধিকার থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত তারা। খাওয়াদাওয়াসহ সুস্থ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার কোনো সুযোগের সন্ধান নেই তাদের। যেকারণে মৃত্যুর অপেক্ষায় বেঁচে থাকা এসমস্ত মানুষগুলোর নাম ঠিকানা নেই। সড়কের মধ্যে যাদের দেখা মেলে বেশিরভাগের শরীরেই রোগের বাসা।
সংবিধান অনুযায়ী, দেশের সব মানুষের মৌলিক চাহিদা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তবে কোনো সরকারই সেরকম কোনো প্রচেষ্টার নজির নেই।
সড়কে বসবাস করা এসমস্ত মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে-এমন মন্তব্য করে রাজধানীর ২৫০ শয্যা টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আয়শা আক্তার বলেন, মানসিক ও শারীরিকভাবে এদের বেড়ে উঠা হয় না। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও দুর্বল থাকে, অসুস্থ হলে হাসপাতালেও নিয়ে আসা হয় না। এ ক্ষেত্রে শিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুচিকিৎসা ও সঠিক নিয়মে জীবনযাপন করতে পারলেই স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে।
এদিকে এমন অবস্থাকে সামাজিকভাবে মৃত্যুর (Social Death) আগেই মানুষের অস্তিত্ব মুছে যাওয়ার প্রক্রিয়া বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রাশেদা রওনক খান। তিনি এনপিবি’কে জানান, এই মানুষগুলো আইনের চোখে অজ্ঞাত, সমাজের চোখে অপ্রয়োজনীয় আর রাষ্ট্রের চোখে পরিসংখ্যান। মানুষের এমন মৃত্যু কেবল দারিদ্রের ফল নয়, বরং রাষ্ট্র ও সমাজের অনুভূতিহীন নগর সংস্কৃতির ফল। নগরের হৃদয়ে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা রমনা পার্কের মতো ঐতিহাসিক ও প্রকৃতিক স্থানে অচেনা মৃতদেহের উপস্থিতি আসলে আমাদের নাগরিক বিবেকের অবক্ষয়ের ইঙ্গিত দেয়।
তথ্য বলছে, গত ১৫ বছরের ১৫ হাজারের বেশি মৃতদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম ফাউন্ডেশন। এর মধ্যে রয়েছে নারী, শিশু ও নবজাতক। যাদের মধ্যে অনেকেরই কোনো আর পরিচয়ের সন্ধান মেলে না।
নাম পরিচয়হীন মরদেহ দাফনকারী বেসরকারি সংস্থা আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে এনপিবি-কে জানায়, পুলিশ ও মর্গ থেকে বলা হলে মরদেহ সংগ্রহ করে দাফন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। মাঝে মধ্যে তারাও খবর পেলে এমন মরদেহ উদ্ধার করে প্রথমে হাসপাতালে ও পরে দাফন করে থাকে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ-ডিএমপি’র গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগে উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, উদ্ধারের পর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, ময়নাতদন্ত করা এবং নাম পরিচয় সনাক্তের চেষ্টা করা হয়। পরিচয় মিললে হস্তান্তর করা হয় আর যাদের পরিচয় পাওয়া যায় না তাদের ডিএনএ নমুনা রেখে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। নাম পরিচয়হীন মরদেহ বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে দাফনও করার কথা জানান ডিএমপির এই কর্মকর্তা।
মন্তব্য করুন