


দেশের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উচ্চ শিক্ষালয় সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি আবাসিক হল রয়েছে। দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের দখলে থাকায় ঠুনকো বিষয় নিয়ে ছাত্রহলে হরহামেশাই সংঘর্ষ হতো। হলে থাকতে হওয়া লাগতো ছাত্রলীগের কর্মী।
গত বছরের ৫ আগস্টে সরকার পতনের পর নতুন বাস্তবতার মুখ দেখেছে শাবিপ্রবির আবাসিক হলগুলো। হলগুলো হয়েছে দখলমুক্ত, ফিরেছে স্বাভাবিক শিক্ষার্থী-নির্ভর পরিবেশ। প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে মেধা ও দারিদ্র্যতার ভিত্তিতে সিট বণ্টন হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। অবসান হয়েছে ভয়-ভীতি ও দলীয় চাপের সংস্কৃতি।
বিশ্ববিদ্যালয়সূত্রে জানা যায়, শাবিপ্রবিতে গত এক যুগের বেশি সময় আবাসিক হল ছাত্রলীগের দখলে ছিল। ৭ গ্রুপে বিভক্ত ছিল নিষিদ্ধ এই সংগঠনটি। এক দশকের বেশি সময় ধরে ছিল না কমিটি। গ্রুপিং আধিপত্য ধরে রাখতে প্রায়ই সংঘাতে জড়াতো নেতাকর্মীরা। শরীরে ধাক্কা লাগা, গোসলখানায় আগে ঢুকা, ডায়নিংয়ের চেয়ারে বসা ইত্যাদি তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে বেধে যেতো সংঘাত। গত তিন বছরে এমন প্রায় ত্রিশটির অধিক ঘটনা রয়েছে।
এ ছাড়া র্যাগিং ছিল মাত্রাতিরিক্ত। আবার এসব ঘটনায় ছত্রচ্ছায়া ও প্রশাসনিক বৈধতা দেওয়া হতো বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন ট্যাগ দিয়ে বৈধ শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দেয়া হতো জোরপূর্বক। সবসময়ই আতঙ্কে থাকতেন হলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা।
আবাসিক হলসূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি হলে সর্বমোট ২,৯৭৭টি আসন আছে। ছাত্রদের মধ্যে মাত্র ২৪ শতাংশ আবাসিক হলে থাকে, আর ছাত্রীদের মধ্যে ৪৯ শতাংশের এই সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ ৭৪ শতাংশ ছাত্র এবং ৫১ শতাংশ ছাত্রী হলের বাইরে থাকেন। ছয়টি হলের মধ্যে তিনটি ছাত্রদের জন্য এবং তিনটি ছাত্রীদের জন্য। এর মধ্যে ছাত্রহলের প্রায় ১৪শ আসনের মধ্যে পূর্বে ৮০ শতাংশই ছাত্রলীগের দখলে ছিল।
এতে বেশিরভাগসময়ই ছাত্রলীগের নেতারা চারজনের কক্ষে এক থাকতেন। অন্যদিকে চারজনের রুমে ১০ থেকে ১২ জন করে গণরুম তৈরি করে মানবেতর জীবনযাপন করতেন শিক্ষার্থীরা। হলে থাকা ছাত্রলীগনেতাকর্মীদের আবার অনেকেরই ছাত্রত্ব ছিল না। কেউ কেউ ছিল মাদকাসক্ত, টেন্ডারবাজ, নারী উত্যক্তকারী, ছাত্র নির্যাতনকারী, বহিষ্কৃত, ধর্ষণের অভিযুক্ত, মামলার আসামীসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত। তবে এই চিত্র বদলেছে। এখন বৈধভাবে নিজেদের জন্য একক আসন পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
বিগত একবছর পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, আবাসিক হলে কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। র্যাগিং, মারামারি কিংবা হল থেকে বের করে দেওয়ারও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কোনো অপরাধের চিত্রও তেমন দেখা যায়নি। বর্তমানে হলগুলোর পরিবেশ পরিবর্তনকে ইতিবাচক মনে করছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে স্বাধীনভাবে থাকার সুযোগ, নিরাপত্তাবোধ এবং শিক্ষাবান্ধব পরিবেশের প্রত্যাশা। শিক্ষার্থীরা বলছেন, পূর্বে ছাত্রলীগের আশ্রয়ে মিছিল-মিটিং কিংবা সারারাত দলীয় কর্মসূচির কারণে পড়াশোনামুখী শিক্ষার্থীরা আবাসিক হলে থাকতেন না।
এমনকি থাকার মতো সুযোগ সুবিধা ছিলনা। বিশেষ করে বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীরা হলে তেমন থাকতেন না। যারা গুটিকয়েক ছিলেন তাদের ক্লাস-পরীক্ষা বাদ দিয়ে অনেকসময় কর্মসূচিতে থাকতে হতো। নয়তো রাতের আধারে হলছাড়তে বাধ্য করা হতো। অনেকসময় বিছানাপত্র ছাত্রলীগের কর্মীরা কক্ষের বাইরে ফেলে রাখতেন। বর্তমানে বৈধভাবে বিভাগগুলোর মধ্যে সমভাবে আসনবণ্টনের কারণে বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীরাও হলে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন।
আবাসিক শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ বলেন, ‘বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা আগে হলে উঠছে চাইতো না। মেসে বাড়তি খরচে থাকতে হতো। হলে উঠতেও তেমন সাহস করতো না। এখন সবার জন্য সুযোগ এসেছে। হলে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা সাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারছে।’
পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আল আমিন বলেন, ‘একসময় ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও ক্ষমতা প্রদর্শনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটত। এতে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার্থীরাও আতঙ্কে থাকত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সেই চিত্রে পরিবর্তন এসেছে। এখন হলগুলোতে আগের মতো সংঘর্ষ দেখা যায় না। হলে ফিরে এসেছে স্বাভাবিক পরিবেশ, বাড়ছে পড়াশোনার সুযোগ ও শিক্ষার্থীদের স্বস্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশ ধরে রাখতে এই ইতিবাচক পরিবর্তন অব্যাহত থাকবে আশা করছি।’
সমাজকর্ম বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তুষি ঘোষ বলেন, ‘৫ আগস্টের পর দলীয় দখলমুক্ত হলগুলো শুধু নিরাপত্তাই বাড়ায়নি বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তারও পুনর্গঠন ঘটিয়েছে। আমরা আশাবাদী, এই পরিবেশ টেকসই হবে।’
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ফয়সাল হোসেন বলেন, ‘বিজয় ২৪ হলের একজন আবাসিক শিক্ষার্থী হিসেবে আমি ৫ আগস্টের বিপ্লব পরবর্তী সময়ে কোনো সংঘর্ষ দেখিনি। পলিটিক্যাল কোনো হ্যারাসমেন্ট ছাড়া হলের শিক্ষার্থীরা ভালো আছে। কিন্তু খাবারের মান ও ওয়াইফাইসহ কিছু সমস্যা এখনো বিদ্যমান।’
এ বিষয়ে বিজয়-২৪ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. জামালউদ্দিন এনপিবিকে বলেন, ‘বিগত একবছরে তাঁরা বৈধভাবে আসন বণ্টন করে আসছেন। অছাত্র কেউ হলে থাকার সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে আমরা কাজ করছি। কোনো ধরনের সংঘাত ঘটেনি।’
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সাজেদুল করিম এনপিবিকে বলেন, ‘আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও আবাসিক হল সবসময় সুশৃঙ্খল থাকবে, সংঘাত থাকবে না। সবাই যেন আমরা শান্তিপূর্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে থাকতে পারি। এ প্রেক্ষিতে আমরা যা যা করা দরকার আমরা সেই চেষ্টা করছি। একইসাথে আবাসিক হলের নির্মাণ কাজ চলছে। আশা করি হল নির্মাণসম্পন্ন হলে সকল শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসেই থাকতে পারবে।’
মন্তব্য করুন