মঙ্গলবার
১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
মঙ্গলবার
১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ভূমিকম্প ঝুকিতে শিল্পাঞ্চল রূপগঞ্জ

আতাউর রহমান সানী, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:২৭ পিএম
শিল্প কারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ফাটল
expand
শিল্প কারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ফাটল

আতাউর রহমান সানী, রূপগঞ্জ : রাজধানী ঢাকার খুব কাছে রূপগঞ্জ উপজেলার অবস্থান। এ উপজেলায় ছোট বড় মিলিয়ে এক হাজারের অধিক শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে।

এ কারণে রূপগঞ্জ উপজেলা মানুষের কাছে শিল্পাঞ্চল হিসেবেও পরিচিত। শিল্প কারখানাকে কেন্দ্র করে জীবন মান উন্নয়নের পাশাপাশি নির্মাণ করা হয়েছে বাড়িঘর।

এসকল শিল্প কারখানা ও বাড়িঘরের মাঝে সিংহ ভাগই বিল্ডিংয়ের ভবন কোড না মেনে নির্মাণ করা হয়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।

গত ২১ নভেম্বর ভূমিকম্পে বেশকয়েকটি শিল্প কারখানা, বাড়িঘর ও মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ফাটল দেখা দিয়েছে। এছাড়া ভূমিকম্পে দেয়াল ধসে ফাতেমা আক্তার নামে এক ১০ মাসের শিশুর মৃত্যু হয়। ফলে ভূমিকম্পে বাড়িঘর ও শিল্প কারখানা গুলোতে বড় ধরনের ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে ধসে পড়তে কয়েক হাজার ভবন ও শিল্প-কারখানা, মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে প্রায় অর্ধলাখ মানুষের। এমনটাই মনে করছেন ভূমিকম্প বিশ্লেষকরা। নকশা বহির্ভূত শিল্প কারখানা ও বাড়ির ভবন গুলোতে দায়সারা অভিযান চালায় প্রশাসন ও রাজউক। তবে গত কয়েকমাস আগে রূপগঞ্জের নকশাবহির্ভূত ভবনগুলোর বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছিল রাজউক। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সে অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে ২০২৩ সালে দুইটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল রূপগঞ্জ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভবন নির্মাণের জন্য বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবনের নকশা, নির্মাণ এবং পরিবর্তন এবং নিয়মনীতি ও মানদন্ডের একটি সেট। যেটির মাধ্যমে জনসাধারণের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা যেমন ভবন ধস ও ক্ষতি প্রতিরোধ করা। বিল্ডিং কোড অনুযায়ী সঠিক নকশা, উন্নত মানের রড, ইট, বালু ও সিমেন্ট ব্যবহার করতে হয়। রূপগঞ্জ উপজেলায় এক হাজারের অধিক শিল্প কারখানা গড়ে উঠলেও বেশিরভাগ কারখানাতেই মানা হয়নি বিল্ডিং কোড। কারখানা কর্তৃপক্ষ স্থানীয় পৌরসভা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ছাড়পত্র নিয়ে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো ভবন নির্মাণ করেছে। এতে প্রায় সময়ই কারখানা গুলোতে ঘটে বড় ধরনের দূর্ঘটনা।

২০২১ সালের ৮ জুলাই গোলাকান্দাইলের হাসেম ফুড কারখানায় অগ্নিকান্ডে ৫৪ জন নিহত হয়। অগ্নিকান্ড হওয়া কারখানার বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। অগ্নিকান্ড হওয়া ভবনটিকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হলেও ভবনটি এখনো ভাঙ্গে নি কারখানা কর্তৃপক্ষ। ভবনটির আশপাশে শতাধিকের উপরে বসতবাড়ি রয়েছে। বড় ধরনের ভূমিকম্পে ভবনটি ধসে পড়লে কয়েক হাজার মানুষের প্রাণহানীর আশঙ্কা রয়েছে। গত শুত্রবারের ভূমিকম্পে ভবনটির পলেস্তরা খসে পড়তে দেখা গেছে।

গত শুক্রবার সকাল ১০.৩৮ মিনিটের ভূমিকম্পে রূপগঞ্জের এওয়ান পোলার, আবুল খায়ের গ্রুপের রবিনটেক্স কারখানা ও ম্যাক্স সুয়েটারসহ বেশকয়েকটি শিল্প কারখানার ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর মধাবদী এলাকা। পরে গত কয়েক দিনে বেশকয়েকবার রূপগঞ্জসহ সারাদেশে হালকা ভূমিকম্প অনূভূত হয়। মধাবদী থেকে থেকে রূপগঞ্জ উপজেলার দূরত্ব প্রায় ১১ কিলোমিটার। রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় আরো বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা।

এর আগেও ভূমিকম্পে কেটেঁছে রূপগঞ্জ উপজেলা। ২০২৩ সালের ২৫ এপ্রিল একটি ভূমিকম্প হয় যার উৎপত্তিস্থল ছিল রূপগঞ্জের তারাব। রিখটার স্কেলে এটি ছিল ৪ মাত্রার। একই বছরের ১৭ এপ্রিল ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল রূপগঞ্জের ডহরগাঁও। সেই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩ মাত্রা। এ কারণে রূপগঞ্জ উপজেলাও বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুকিতে রয়েছে। বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে শিল্প কারখানার ভবন ধসে বড় ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা। এদিকে, গত ২১ নভেম্বর ভূমিকম্পে আবুল খায়ের গ্রুপের রবিনটেক্স কারখানার তিনটি ভবনের ফাটল দেখা দেয়। তাতে শ্রমিকদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এসময় শ্রমিকরা কাজে যোগদান না করে অসন্তোষ প্রকাশ করে।

গত শনিবার ২য় দফা ভূমিকম্পে ভবন গুলো কেপেঁ উঠে। এসময় শ্রমিকরা আতঙ্কিত হয়ে তাড়াহুড়ো করতে নামতে গিয়ে প্রায় শতাধিক শ্রমিক আহত হয়। এছাড়া তারাব পৌরসভার ম্যাক্স সোয়েটার কারখানার ভবনে ফাটল। শ্রমিকদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে প্রশাসন এসে শ্রমিকদের বুঝিয়ে কাজ যোগদান করায়। ভুলতা এলাকার এওয়ান পোলার কারখানার দেওয়ালে ফাটল দেখা দেয়। এতে কারখানার শ্রমিক ও মালিকপক্ষের মাঝে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। রোববার তিন দিনের জন্য কারখানা ছুটি ঘোষণা কর্তৃপক্ষ।

নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ব্যাঙের ছাতা নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন। ভবনের নির্মাণের অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা, সঠিক নকশা ও জরুরী সিড়ি ও আবাসিক অনুমোদন থাকা জরুরী। এ উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৫ হাজারের অধিক বহুতল ভবন রয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। এসব ভবনের বেশির ভাগই অনুমোদনহীন। নকশা অনুমোদন ছাড়াই তৈরি হয়েছে এগুলো। আর যে গুলো অনুমোদন নেওয়া হয়েছে সেগুলোর অনুমোদনও নেওয়া হয়েছে স্থানীয় প্রশাসন ও পৌরসভা কর্তৃপক্ষকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে। তারাব পৌরসভা, কাঞ্চন পৌরসভা, ভুলতা ও গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের বহুতল ভবনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এসকল এলাকার ভবন নির্মাণের মানা হয়নি কোন প্রকার নিয়ম নীতি।

এছাড়া পূর্বাচল উপ-শহরেও নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন। রাজউকের কাছ থেকে অনুমতি না নিয়ে অনেক ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। পূর্বাচলে রাজউক থেকে ৩৬ টি নকশার অনুমোদন দেওয়া হলেও নির্মাণ কাজ চলছে শতাধিকের উপরে।

গত শুক্রবার ভূমিকম্পে রূপগঞ্জে বিভিন্ন স্থানে বহু ভবনের ফাটল দেখা দিয়েছে। এছাড়া অনেক ভবন হেলে বাকা হয়ে পড়েছে। গোলাকান্দাইল ৫ নং ক্যানাল এলাকায় দেয়াল ধসে ফাতেমা ১০ মাসের এক শিশু নিহত হয়েছে। এসময় শিশুটির মা বিলকিস আক্তার গুরুতর আহত হয়। কাঞ্চনে চন্ডীতলা মন্দিরের দেয়াল ভেঙ্গে পড়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এখানে বিল্ডিং কোড না মেনে যেভাবে অপরিকল্পিত উপায়ে ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়েছে, তাতে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও একটু বেশি সময় স্থায়ী হলে ঘটে যেতে পারে বড় ধ্বংসযজ্ঞ। কাজেই এ ব্যাপারে অবহেলা করার সুযোগ নেই। সবার আগে ভেঙে ফেলতে হবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো। তারপর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে মহড়া ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

সরকারি মুড়াপাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর নুরুজ্জামান বলেন, ‘অনেক ভবন পুরানো হয়ে গেছে। তারাব চনপাড়া ঘনবসতিপূর্ন এলাকা। এগুলোর প্রায় সিংহভাগই ঝুঁকিপূর্ণ। নতুন অনেক ভবনও ভূমিকম্প প্রতিরোধী নকশা ছাড়া নির্মাণ করা হচ্ছে। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে এক থেকে দেড় লাখ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আনোয়ার হোসেন বলেন, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার এবং সাগরের নিকটে হওয়ায় নির্মাণ সামগ্রীর কিউরিং প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় ভবনগুলো আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।

প্রকৌশলী আক্তার হোসেন বলেন, যেসব ভবন রেট্রোফিটিং করে ঝুঁকিমুক্ত করা সম্ভব, সেগুলো করতে হবে। আর যেগুলো টেকনিক্যালি ঝুঁকিমুক্ত করা সম্ভব নয়, সেগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। উদ্ধারকারী বাহিনীর গাড়ি চলাচল নিশ্চিত করতে সংকীর্ণ সড়কগুলো প্রশস্ত করতে হবে। পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচিত নিয়মিত মানুষকে সতর্ক করা।

তারাব পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ নিগার সুলতানা বলেন, আমাদের ক্ষমতা সীমিত। ম্যাজিষ্ট্রেসি পাওয়ার নেই। অবৈধ ভবন কত আছে এমন পরিসংখ্যান নেই। তবে অবৈধ ভবন চোখে পড়লে নোটিশ করি। ব্যবস্থা নেই। আমাদের লোকবল কম। রূপগঞ্জ বড় ভূমিকম্প হলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটতে পারে।

উপজেলা দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আইমিন সুলতানা বলেন, আসলে উপজেলা পর্যায়ে কোন প্রশিক্ষণ নেই। তবে দুর্যোগ প্রশমন দিবসে ভূমিকম্প সংক্রান্ত মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জয় বলেন, রাজউক অভিযান চালিয়েছিল। আবারও অভিযান পরিচালনা করা হবে।

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

X