মঙ্গলবার
১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
মঙ্গলবার
১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ভালুকায় মুক্ত দিবস আজ 

এস এম মিজানুর রহমান মজনু, ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:২৭ এএম
ফাইল ছবি
expand
ফাইল ছবি

১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর ৮ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের ভালুকায় মুক্ত দিবস আজ।

এ দিনে পাকিস্তানি পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে হাজারো রাজাকার-আলবদর ও পাক সেনার আত্বসমর্পনের মধ্য দিয়ে ভালুকা থানা পাক হানাদার মুক্ত হয়।

এই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতার লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলন করেন।

১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি পাক বাহিনী ঢাকায় আক্রমণ করলে সে দিন থেকেই সারা বাংলাদেশে পাক বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। শ্রীপুর, ত্রিশাল, ফুলবাড়িয়া, গফরগাঁও ও ভালুকা উত্তরাঞ্চলীয় প্রবেশদ্বার ৭১ রণাঙ্গনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ছিল।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালে ভালুকার সর্বস্তরের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধা পরিচালনার জন্য দেশ প্রেমিক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-যুবক, কৃষক ও শ্রমিকসহ জনগণের উপস্থিতিতে ভালুকায় গঠন করা হয় সংগ্রাম পরিষদ। ওই পরিষদের নেতৃত্বে ছিলেন আফসার উদ্দিন আহমেদ।

১৯৭১ সালে তৎকালীন সময় ভালুকার রাজৈ ইউনিয়নের পারুলদিয়া গ্রামের আব্দুল হামিদ মেম্বারের কাছ থেকে একটি মাত্র রাইফেল নিয়ে আট জন সদস্য নিয়ে মল্লিকবাড়ি বাজারে খেলু ফকিরের বাড়িতে মুক্তি বাহিনীর একটি গেড়িলা দল গঠন করে।

পরবর্তীতে ভালুকা থানা দখল করে প্রায় ১৪-১৫টি রাইফেল ও একটি এল এম জিসহ প্রচুর গোলা-বারুদ সংগ্রহ করে, এর কয়েক দিনের মাথায় শ্রীপুরের কাউরাইদ হতে খীরু নদী ভালুকা থানায় আসার পথে রাজৈ ইউনিয়নের পনাশাইল নামক স্থানে পাকিস্তানি পাক হানাদার বাহিনীর অস্ত্র ও গোলা-বারুদসহ একটি নৌকা আটক করেন মুক্তিযোদ্ধারা। এ সময় প্রচুর অস্ত্রসস্ত্র উদ্ধার করে গেরিলা একটি দল শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত হয়।

আফসার উদ্দিন আট সদস্যর একটি দল যা পরবর্তীতে প্রায় সাড়ে চার হাজার মুক্তিযুদ্ধার একটি বিশাল বাহিনী গড়ে উঠে। এফ জে ১১ নম্বর সেক্টরের ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা ও ঢাকা উত্তর জেলা সাব-সেক্টর অধিনায়ক আফসার ব্যাটেলিয়ান নামে পরিচিত লাভ করে।

যুদ্ধকালীন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের দ্রুত চিকিৎসার জন্য ডাক্তার রমজান আলী তরফদার তত্ত্বাবধানে পাঁচজন ডাক্তার, দশজন সহকারী ও চারজন নার্সর সমন্বয়ে আফসার ব্যাটালিয়ন হাসপাতাল নামে একটি ভ্রাম্যমান হাসপাতাল পরিচালিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছুদিন রেড ক্রিসেন্ট সংস্থার দ্বারা পরিচালিত হয়।

১৯৭১ সালে শুক্রবার ২৫ জুন ভালুকা টু গফরগাঁও সড়কের ভাওয়ালিয়া বাজু নামক স্থানে শিমুলিয়া নদীর পাড়ে পাকিস্তানি পাক বাহিনীর সঙ্গে আফসার বাহিনী সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন, দিন-রাত দীর্ঘ ৩৬ ঘন্টা একটানা যুদ্ধ স্থায়ী হয়।

শুক্রবার শুরু হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনে পাক বাহিনী চারিদিকে পানি-বৃষ্টিত নদীর পূর্বপাড়ে গোয়ারী যোগীপাড়া নামক স্থানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। পরে শুক্রবার দিন-রাত তিন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনের মুখে অনেক পাকসেনা নিহত হয়।

পরদিন শনিবার ঢাকা হতে আকাশ পথে আসা পাক হানাদার বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ করে ভাড়ি মেশিনগানের সেলিং শুরু করে।

মুক্তিযোদ্ধারাও হেলিকপ্টার লক্ষ করে পাল্টা ব্রিটিশ এল এম জির সাহায্যে গোলা বর্ষণ অব্যাহত রাখলে হেলিকপ্টারটি পিছু হটে। পরে শনিবার সন্ধ্যার দিকে যুদ্ধক্ষেত্রে চার কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে ধলিয়া গ্রামে ধলিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে হেলিকপ্টার থেকে পাকসেনা নামিয়ে দিলে ডিফেন্স ছেড়ে চলে আসে মুক্তিযোদ্ধারা।

এই যুদ্ধে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন মল্লিকবাড়ির তরুণ যোদ্ধা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র আব্দুল মান্নান। এ যুদ্ধে মজিবর রহমানসহ আহত হয় আরও পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা নদীর পশ্চিম দিকে একটানা দুুুদিন সম্মুখ যুদ্ধ করায় পাকসেনা নিহত হয়।

১৯৭১ ঐতিহাসিক ওই যুদ্ধের খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, অল-ইন্ডিয়া রেডিও ও বিবিসি হতে ফলাও করে সম্প্রচার করা হয়।

এ যুদ্ধের পর ভালুকা থানা ও বাজার এলাকায় পাক বাহিনীর ক্যাম্পটি শক্তিশালী করা হয়। স্থানীয় মুসলিমলীগ নেতারা এখানে গড়ে তোলেন একটি বিশাল রাজাকার-আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প। এসব রাজাকার ও আলবদররা ভালুকার বিভিন্ন গ্রামে দিনের পর দিন মানুষ হত্যা, নারী ধর্ষন ও ঘর-বাড়িতে অগ্নি সংযোগসহ লুটপাট চালায়।

যুদ্ধকালীন একাধিক বার ভালুকা পাক হানাদার ক্যাম্পে আক্রমন চালিয়েছে। এছাড়াও আমলীতলা যুদ্ধ, বল্লা যুদ্ধ, শ্রীপুর, ত্রিশাল, ফুলবাড়িয়া, গফরগাঁও ও ভালুকার বিভিন্ন স্থানে পাকসেনা-রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের অসংখ্য যুদ্ধ হয়।

দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে আফসার উদ্দিনের ছেলে নাজিম উদ্দিন এবং মল্লিকবাড়ির আব্দুল মান্নানসহ ৪৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন।

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

X