বুধবার
০৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বুধবার
০৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রায়পুর ভূমি অফিসে দালালদের রাজত্ব, ঘুষ ছাড়া নড়ে না ফাইল ‎

‎রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:৫৮ পিএম
রায়পুর ভূমি অফিস
expand
রায়পুর ভূমি অফিস

‎লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় ও ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের অফিসগুলো এখন দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে—এমন অভিযোগ উঠেছে সাধারণ সেবা প্রত্যাশীদের কাছ থেকে।

‎নামজারি (জমাখারিজ), খাজনা আদায় কিংবা নাম সংশোধনের মতো সাধারণ সরকারি সেবার জন্য ঘুষ না দিলে কাজ হয় না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। ভূমি অফিসের কিছু কর্মচারী ও দালালদের সমন্বয়ে গঠিত এক সিন্ডিকেট নিয়মিতভাবে সেবা প্রত্যাশীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে। ‎ ‎অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি)-এর নাম ভাঙিয়ে অফিস সহায়ক, অফিস সহকারী, হিসাবরক্ষক, নাজির ও দালালের মাধ্যমে ঘুষের টাকা নিচ্ছে। দালালের মাধ্যমে টাকা না দিলে ফাইল মাসের পর মাস ঝুলে থাকে। ‎ ‎সেবা প্রক্রিয়ায় ঘুষের ধাপও একাধিক। অনলাইনে আবেদন করার পর ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে খসড়া খতিয়ানের প্রস্তাব নিতে ঘুষ, প্রত্যয়নে ঘুষ, নাজিরের টেবিলে ঘুষ—সব ধাপেই বাড়তি টাকা দিতে হয় বলে অভিযোগ। ‎ ‎সরকার নির্ধারিত খরচ মাত্র ১,১৭০ টাকা হলেও অনেক সময় ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ টাকা পর্যন্ত আদায় করার ঘটনাও ঘটেছে। ‎ ‎একটি ভিডিও চিত্রে দেখা যায় উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের বাসিন্দা “নামজারি করতে গেলে অফিস সহায়ক মনির ৩,৬০০ টাকা চায়। সরকারি খরচসহ মোট ৪,৭০০ টাকা দিতে হয়েছে তাকে। অভিযোগ রয়েছে টাকা না দিলে ফাইলই ওঠে না।” ‎ ‎বামনী ইউনিয়নের আউয়াল মিয়া জানান, “হিসাবরক্ষক জাহাঙ্গীর আলম ৩,৭০০ টাকা নিয়েও কাজ করে দেয়নি, টাকা ফেরতও দেয়নি।” ‎ ‎দক্ষিণ চর আবাবিল, উত্তর চরবংশী ও বামনী ইউনিয়নের আরও কয়েকজন ভুক্তভোগী একই ধরনের ঘুষের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। ‎ ‎এছাড়ও উপজেলার ২নং উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের খাশেরহাট ভূমি অফিসে তহশিলদার আব্দুস সত্তারসহ একাধিক কর্মচারীর বিরুদ্ধে ঘুষ বাণিজ্য, দালাল সিন্ডিকেটের দখল এবং তদন্তে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ‎ ‎ ‎অভিযোগ সূত্রে জানা যায় নামজারি, খাজনা ও নালিশী ভূমি মামলার সরজমিন তদন্তে মোটা অংকের ঘুষ দাবী করেন তহশিলদার। তাঁর নেতৃত্বে দালাল জুয়েল, রশিদ, রাকিব, মনির মৃর্ধাসহ কয়েকজন প্রকাশ্যে অফিস নিয়ন্ত্রণ করছে। ‎ ‎সরজমিনে দেখা গেছে—আওয়ামী লীগ ঘরানার ব্যানার ব্যবহার করা এসব দালাল দিনের পর দিন অফিসে অবস্থান করে সাধারণ সেবা গ্রহীতাদের নানাভাবে হয়রানি করছে।

‎অভিযোগ রয়েছে—তহশিলদার আব্দুস সত্তার দালালদের মাধ্যমে প্রতি ফাইল থেকে ৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেন। নালিশী ভূমি মামলার তদন্ত রিপোর্টের জন্যও ৫০০ টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করা হয়। ‎ ‎চরমোহনার বাসিন্দা মন্তাজ মিয়া বলেন, ১১৮৬ নং খতিয়ানের আমার জমির নামজারি চলমান অবস্থায় সানজিদা আক্তার আদালতে মামলা করেন। আদালতের নির্দেশে চরবংশী ভূমি অফিস তদন্তের দায়িত্ব পায়। কিন্তু তহশিলদার আমাকে না জানিয়ে ফাতেমা বেগমকে আমার প্রতিনিধি দেখিয়ে নোটিশ রিসিভ করান। পরে সরজমিন তদন্তের অনুরোধ করলে তিনি আমার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ চান। টাকা না দিলে আমার বিপক্ষে প্রতিবেদন দেবেন বলে হুমকি দেন। ‎ ‎তিনি আরও বলেন, আমি ঘুষ না দেয়ায় আমার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন এবং এখনো নানা উপায়ে হয়রানি করছেন। আমি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।

‎স্থানীয়দের দাবি—ইউনিয়নের ১নং খতিয়ানভুক্ত সরকারি খাস জমি দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন মাস্টারসহ কয়েকজনের দখলে রয়েছে। তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেও ভূমি অফিস কোনো তথ্য দেয়নি। ‎ ‎সংবাদ সংগ্রহে গেলে দালাল সিন্ডিকেটের মূল হোতা জুয়েল সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে স্থান ত্যাগ করেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। ‎ ‎অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তহশিলদার আব্দুস সত্তার বলেন,“আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। অফিসে কোনো দালালকে আগামীকাল থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকারি খাস জমির তথ্য দেওয়ার আইনগত সুযোগ নেই।” ‎‎ ‎রায়পুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নিগার সুলতানা বলেন,“আমার অফিসে সরকারি ফি ছাড়া অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয় না। কেউ আমার নাম ব্যবহার করে টাকা নিলে সেটা আমার জানা নেই। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” ‎ ‎উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, “ভূমি অফিসে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ আমার জানা নেই। যদি এমন ঘটে থাকে, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ‎ ‎স্থানীয়দের দাবি—দালাল সিন্ডিকেটের কারণে রায়পুরের ভূমি অফিসগুলোতে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সরকারি নির্ধারিত ফি’র চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা ঘুষ হিসেবে গুনতে হচ্ছে। ‎ ‎ভূমি প্রশাসনের উদাসীনতা ও রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কারণে এ অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না বলে মনে করছেন সচেতন মহল।

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন