বৃহস্পতিবার
২৭ নভেম্বর ২০২৫, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বৃহস্পতিবার
২৭ নভেম্বর ২০২৫, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ধীরাজের বিদায়ে থমকে গেল মাথিনের জীবন

শাহীন মাহমুদ রাসেল, কক্সবাজার প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ১১:১০ এএম
টেকনাফ থানা
expand
টেকনাফ থানা

ভোরের আলো মাত্র ফুটেছে। সবুজ পাহাড়ের আড়াল ভেঙে বাতাসে ভেসে আসে কণ্ঠস্বর- হাসির, কোলাহলের, জীবনের। দেশের সর্ব দক্ষিণের স্থলসীমান্ত টেকনাফ থানার আধাপাকা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তরুণ পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্য তাকিয়ে থাকেন সেই পরিচিত দৃশ্যের দিকে। রঙিন রাখাইন পোশাক পরা মেয়েরা পাতকুয়া থেকে পানি তুলছে, হাসছে, গল্প করছে। কিন্তু সেদিন ধীরাজের দৃষ্টি থেমে যায় এক মেয়ের ওপর। স্নিগ্ধ মুখ, গভীর অথচ লাজুক দৃষ্ট- যেন পাহাড়ি সকালের আলো গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে আছে সে। মেয়েটির নাম মাথিন।

এরপর টেকনাফের নিসর্গমাখা দুপুরে প্রথমবার দেখা হয়েছিল ধীরাজ আর মাথিনের। থানার উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা ধীরাজের চোখে ছিল দায়িত্বের দৃঢ়তা, আর মাথিনের চোখে তরুণী কোমল লাজুক হাসি। সেই এক দেখাতেই ভেতরে ভেতরে দু’জনেরই কেমন যেন অচেনা আলোড়ন জেগে উঠেছিল। ধীরে ধীরে কূপের ধারে জল আনতে আসা মাথিনের পদচারণা হয়ে উঠেছিল ধীরাজের প্রতিদিনের অপেক্ষা, আর ধীরাজের সামান্য কথাও হয়ে উঠত মাথিনের দিনের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুহূর্ত। সমাজ-সংসারের অনেক দেয়াল থাকলেও হৃদয়ের পথে ছিল না কোনো বাধা। প্রেম তাদের কাছে ছিল কোনো চিঠি নয়, কোনো প্রতিশ্রুতিও নয়- ছিল নিঃশব্দে চোখের ভাষায় লেখা এক গভীর টান, কূপের জলে ভেসে থাকা এক অদৃশ্য আকর্ষণ, আর প্রতিদিনের দেখা হওয়ার সহজ অথচ অমূল্য আনন্দ। সেই মুহূর্তগুলোই ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছিল এক অনন্ত প্রেম- যে প্রেমের আলো আজও মাথিনের কূপের পানিতে ঝিলমিল করে।

একটা প্রেম, যা কথা না বলেও কথা বলে, দূরত্ব না মিটিয়েও হৃদয় ভরিয়ে দেয়। আর শেষ পর্যন্ত যার সমাপ্তি ঘটে এক মৃত্যুতে- অপেক্ষার, অভিমানের, আর চির-অমোঘ ট্র্যাজেডির মৃত্যুতে।

আজ যে কূপটিকে পর্যটকরা ‘মাথিনের কূপ’ নামে চেনে- সেটিই সেই প্রেমের নীরব স্মৃতি, যার জল আজ আর কেউ পান করে না, কিন্তু যার গল্পে অশ্রু ঝরে হাজারো মানুষের চোখে।

প্রবীণদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সময়টা বিংশ শতকের প্রথমভাগ। কলকাতা পুলিশের সুদর্শন কর্মকর্তা ধীরাজ বদলি হয়ে এলেন দূর-দুরান্তের সীমান্ত জনপদ টেকনাফ থানায়। তখনকার টেকনাফ মোটেও আজকের মতো ব্যস্ত শহর নয়- বরং নির্জন, পাহাড়ের আঁধার আর সমুদ্রের বাতাসে মোড়া এক ভৌগোলিক নিঃসঙ্গতা।

ধীরাজ প্রতিদিন থানা চত্বরে বসে থাকা পাতকুয়ার আশপাশে মানুষের আনাগোনা দেখতেন। একদিন ভোরে তিনি দেখলেন- রাখাইন তরুণীদের হাসি-আনন্দে ভরে উঠেছে পাতকুয়া। সেই ভিড়েই দাঁড়িয়ে মাথিন- জমিদার ওয়ানথিনের একমাত্র কন্যা। তার চোখ দুটো যেন অজানা ভাষায় কথা বলছিল। সেই অচেনা ভাষাই ধীরাজকে টেনে নিল আরও গভীরে।

ধীরে ধীরে ভোরের রঙিন মুহূর্ত দুজনের হৃদয়ের সবচেয়ে প্রিয় সময় হয়ে উঠল। চোখে চোখে কথা, লাজুক হাসিতে মিশে থাকা স্বপ্ন- সব মিলিয়ে জন্ম নিল এক অদেখা সম্পর্ক।

টেকনাফ ছোট জনপদ। ধীরাজ-মাথিনের নীরব প্রেম ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। গোপন নজর, কানাঘুষা, সামাজিক বাঁধা- সব কিছুই জড়ো হতে লাগল। তবে প্রেম যখন সত্য, তখন ভয় নয়- স্বপ্নই জয়ী হয়। দুজনেই সিদ্ধান্ত নিলেন- তারা বিয়ে করবেন। ধীরাজ কলকাতায় বাবাকে চিঠি লেখেন সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য। মাথিন তার বাবাকে বোঝান- এমন মানুষই তার জীবনসঙ্গী। জমিদার ওয়ানথিন প্রথমে আপত্তি করলেও শেষ পর্যন্ত মেয়ের সুখের জন্য ছাড় দিলেন। কিন্তু নিয়তির খেলা তখনও পুরোটা শুরু হয়নি।

ধীরাজের ব্রাহ্মণ বাবা তার প্রেমের কথা জেনে প্রচণ্ড রেগে গেলেন। এক জরুরি টেলিগ্রাফ পাঠিয়ে লিখলেন- ‘আমি অসুস্থ। এখনই কলকাতা ফিরে আসো। ছুটি না পেলে চাকরি ছেড়ে এসো।’

এই বার্তাই ধীরাজকে দ্বিধায় ফেলে দিল। প্রেমের টানে থাকবেন, নাকি বাবার নির্দেশে ফিরে যাবেন।

মাথিন কোনোভাবেই তাকে যেতে দিতে চাইলেন না। তার ভয়- ধীরাজ যদি যায়, আর কখনোই ফিরবে না। কিন্তু ভয়ই সত্যি হলো। এক সন্ধ্যায় ধীরাজ কাউকে কিছু না জানিয়ে টেকনাফ ছেড়ে কলকাতা ফিরে গেলেন। মাথিন জানলেন শুধু একটি কথা- ধীরাজ আর ফিরছেন না।

অপেক্ষার প্রেম পরিণত হলো বেদনায়:

ধীরাজের বিদায়ের পর মাথিনের জীবনে নেমে এল এক অদ্ভুত নির্জনতা। তিনি খাওয়া বন্ধ করলেন, কথা বলা বন্ধ করলেন, পানি ছুঁয়েও দেখলেন না। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন- কারও অনুনয়েই তিনি সাড়া দিলেন না। দিনের পর দিন শুকিয়ে যেতে লাগলেন তিনি। কেউ জানত না তার মনে তখন কী চলছিল- শুধু তার চোখে ছিল একটাই প্রশ্ন- ‘ধীরাজ সত্যিই কি আমাকে ছেড়ে চলে গেল?’ এরপর একদিন ভোরে শান্তভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন মাথিন। টেকনাফের আকাশে যেন সেদিন নেমে এসেছিল অদ্ভুত এক নীরবতা।

মাথিনের মৃত্যুর পর মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল তার প্রেমের গল্প। পাতকুয়াটি হয়ে উঠল সবচেয়ে সংবেদনশীল স্মৃতিস্তম্ভ। ১৯৮৪ সালে থানা কর্তৃপক্ষ কূপটি সংস্কার করে নাম দেয়- ‘মাথিনের কূপ’। এরও বহু বছর পর ধীরাজ ভট্টাচার্য তার ভেতরের অপরাধবোধ, অতৃপ্ত স্মৃতি আর ব্যর্থ ভালোবাসার কথা লিখে যান তার আলোচিত গ্রন্থ- ‘যখন পুলিশ ছিলাম’- এ।

কথা বলা হয়নি, সুস্পষ্ট সম্পর্কও স্থাপন হয়নি- কিন্তু প্রেমের তীব্রতা এতটাই ছিল যে তা শতবর্ষ পেরিয়েও যে প্রেমের স্মৃতি আজও টেকনাফের বাতাসে ভেসে বেড়ায়, মাথিনের কূপের স্নিগ্ধ জলধারায় যেন অনন্তকাল ধরে বাজে তাদের মধুর নিশ্বাস। ধীরাজের প্রতীক্ষায় মাথিনের প্রতিটি ভোর, আর মাথিনের হাসিতে ধীরাজের নিঃশব্দ সুখ- সময়ের স্রোত সেগুলোকে মুছে দিতে পারেনি। কূপের ইটের গায়ে, বটগাছের ছায়ায়, শহরের নীরব বিকেলে আজও অনুভব করা যায় সেই অদেখা স্পন্দন; যেন দু’টি প্রাণের অশ্রুসিক্ত ভালোবাসা এখনও থানা চত্বরে গুঞ্জরিত। যুগ পাল্টেছে, মানুষ বদলেছে, কিন্তু ধীরাজ-মাথিনের বিস্মৃত না হওয়া প্রেম যেন বলে দেয়- সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো মরে না, শুধু স্মৃতির রূপ নিয়ে মানুষের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকে।

ত্রিশাল থেকে আসা পর্যটক নুরুজ্জামান লাভু বলেন- ‘বইয়ে পড়েছিলাম মাথিনের গল্প। আজ কূপ দেখে মনে হলো- ভালোবাসা কখনোই মরে না। মাথিনের মৃত্যু দুঃখের, কিন্তু প্রেম তার চেয়েও মহৎ।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইমা ইসলাম বলেন- ‘লাইলি-মজনু বা শিরি-ফরহাদের মতোই মাথিন-ধীরাজের গল্পও কিংবদন্তি। তবে ট্র্যাজেডি আরও নির্মম। কূপে মাথিনের প্রতীকী ভাস্কর্য থাকলে হয়তো ইতিহাস আরও স্পর্শকাতর হতো।’

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের এক পূর্বসূরির অসমাপ্ত প্রেম আজ ইতিহাসের অংশ। মাথিনের কূপকে আমরা সর্বোচ্চ যত্নে সংরক্ষণ করেছি। দেশের মানুষ এখানে এসে যেন সেই প্রেমের জলছাপ অনুভব করতে পারে।’

স্থানীয়দের মতে, পাহাড়ি বাতাস যখন কূপের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, তখন মনে হয়- এখানে আজও দাঁড়িয়ে আছে দুটি আত্মা- ধীরাজ আর মাথিন। একজন অপেক্ষায় ফিরে যায়নি, আরেকজন অপেক্ষা করতে করতে হারিয়ে গেছে। তবুও প্রেম পরাজিত হয়নি। মাথিনের মৃত্যু তাকে মুছে দেয়নি- বরং আরও অমর করেছে। মাথিনের কূপ তাই শুধু ইটের গাঁথনি নয়, এটি ভালোবাসার সামনে মানুষের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের ইতিহাস।

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন