শনিবার
০১ নভেম্বর ২০২৫, ১৭ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শনিবার
০১ নভেম্বর ২০২৫, ১৭ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী রচনার হাজার বছরের ধারা

এনপিবি ডেস্ক
প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:৩৫ পিএম আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:৩১ পিএম
মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী রচনার হাজার বছরের ধারা
expand
মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী রচনার হাজার বছরের ধারা

বিশ্ব ইতিহাসে কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে এত বিপুলসংখ্যক জীবনী রচিত হয়েছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নাম অবশ্যই শীর্ষে থাকবে।

দেড় হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে অসংখ্য সাহিত্যিক, গবেষক, সমাজ সংস্কারক, সামরিক বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক এবং এমনকি তাঁর বিরোধীরাও তাঁকে নিয়ে লিখেছেন। অনেকে তাঁকে মহামানব হিসেবে অভিহিত করেছেন, কেউ আবার মানবতার জন্য তাঁর নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন।

প্রাথমিক উৎস

নবীজিকে জানার প্রথম ও প্রধান উৎস হলো পবিত্র কোরআন। আয়েশা (রা.) নবীজির চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন—“তাঁর চরিত্র ছিল কোরআন।” কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে নবীজির জীবনের নানা দিক প্রতিফলিত হয়েছে—মক্কার কুরাইশদের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন, যুদ্ধের ঘটনা, কিংবা পরিবার-পরিজনের প্রসঙ্গ। পাশাপাশি হাদিস ও প্রাচীন তাফসির সাহিত্যে নবীজির জীবনের খণ্ডচিত্র সংরক্ষিত হয়েছে।

জীবনী রচনার শুরু

নবীজির ইন্তেকালের প্রায় পঞ্চাশ বছর পর থেকে ধারাবাহিক জীবনী রচনার সূচনা ঘটে। এর আগে সাহাবিরাই তাঁকে সরাসরি দেখেছিলেন এবং তাঁদের দৈনন্দিন জীবনেই নবীজির শিক্ষা ও আদর্শ প্রতিফলিত হতো। প্রজন্মের পর প্রজন্ম নবীজিকে জানার প্রবল আগ্রহ থেকেই জীবনী লেখার ধারা শুরু হয়।

নবীজির প্রতি আকুলতা

তিনি নিজেই বলেছেন—“আমার পর এমন কিছু মানুষ আসবে, যারা পরিবার-পরিজন ও সম্পদ বিসর্জন দিয়েও আমাকে একবার দেখতে চাইবে।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৮৩২)। সেই আকাঙ্ক্ষাই সাহাবিদের প্রেরণা যুগিয়েছে তাঁর জীবনকাহিনি লিপিবদ্ধ করতে। কখনো সংক্ষেপে, কখনো বিস্তারিতভাবে বা আংশিকভাবে তাঁরা নবীজির বর্ণনা তুলে ধরেছেন। ধীরে ধীরে এগুলোই পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থে রূপ নিয়েছে।

জীবনীগ্রন্থের দুইটি প্রধান দিক

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর জীবনী আলোচনা মূলত দুইটি অংশে বিভক্ত।

১. সিরাত: সিরাত মানে জীবনী। এটি নবীজির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের ধারাবাহিক ঘটনা বর্ণনা করে। এই ধরনের গ্রন্থকে সাধারণত সিরাতগ্রন্থ বলা হয়।

২. শামায়েল: শামায়েল গ্রন্থে নবীজির দৈহিক গঠন, আচরণ এবং ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়। প্রথম দিকে গ্রন্থকারেরা মূলত নবীজির অবয়ব ও ভঙ্গিমা বিশ্লেষণ করতেন। পরে এটি আরও বিস্তৃত হয়ে নবীজির আচার-আচরণ, ইবাদত, বিনয় ও কোমল স্বভাবসহ ব্যক্তিজীবনের সব দিক অন্তর্ভুক্ত করে।

বিখ্যাত শামায়েলগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

ইমাম তিরমিজির শামায়েল তিরিমিজি (২৭৯ হিজরি)

ইমাম বাগাবির আল আনওয়ার ফিশ শামায়েল (৫১৬ হিজরি)

ইবনে কাসিরের আল-ফুসুল ফি সিরাতির রসুল (৭৭৪ হিজরি)

জালালুদ্দিন সুয়ুতির শামায়িলুশ শারিফা (৭৭৪ হিজরি)

সালেহ আহমাদ শামির মিন মায়িনিশ শামায়েল (জন্ম ১৯৩৪), যা ঢাকা থেকে মুহাম্মাদ স.: ব্যক্তি ও নবী নামে অনুবাদিত।

প্রথম যুগের নবীজীবনী রচনাকারীরা

মহানবী (সা.)–এর প্রথম জীবনী রচনাকারদের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন। তবে ১০৯২ সালে প্রকাশিত আসসিরাতুন নাবাবিয়াহ ফি যাওইল মাসাদিরিল আসলিয়া গ্রন্থে প্রথম তিনজন রচনাকারীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে:

১. সাহল ইবনে হাসমা (রা.) তৃতীয় হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন। কৈশরে মহানবী (সা.)–কে দেখেছেন। উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়ার আমলে (৪১–৬০ হিজরি) মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জীবনী খণ্ডগুলো বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থে সংরক্ষিত রয়েছে।

২. সাইদ ইবনে সাদ ইবনে উবাদা খাজরাজি তাঁর রচনা ইবনে হাম্বল ও আবি-ইওয়ানার মুসনাদ এবং তাবারির তারিখে তাবারি–তে পাওয়া যায়।

৩. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (৭৮ হিজরি) প্রখ্যাত তাফসির বিশারদ। হাদিস ও সিরাতের বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁর লেখা পাওয়া যায়।

তাদের কাজ গ্রন্থাকারে সংরক্ষিত হয়নি এবং পরে একত্রিতও হয়নি।

পরবর্তী প্রজন্মের রচয়িতারা

উরওয়া ইবনে জুবাইর (৯২ হিজরি), সাদ ইবনে মুসাইয়িব, আবদুল্লাহ ইবনে কাব, আবান ইবনে উসমান, ওয়াহাব ইবনে মুনাববিহ, ইবনে শিহাব জুহরি, শুরাহবিল ইবনে সাদ, আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাকর ইবনে হাজাম প্রভৃতি।

তবে উরওয়া, ওহাব ও জুহরির রচনা ছাড়া প্রাচীন অন্যান্য রচনাগুলি হারিয়ে গেছে। কিছু অংশমাত্র বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থে টিকে আছে।

উরওয়া ইবনে জুবাইর এবং প্রাথমিক জীবনী রচনাকারীরা

উরওয়া ইবনে জুবাইর (রা.) ছিলেন সাহাবি আবু বকরের (রা.) বড় মেয়ে আসমার ছেলে। উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেক ও আল-ওয়ালিদের সময়ে নবীজির সময়ের ঘটনা সম্পর্কে চিঠি-পত্রের মাধ্যমে ব্যাখ্যা দিতেন। অনেক ঐতিহাসিক তাঁকে নবীজির “প্রথম জীবনীকার” হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

ভারতের বিশিষ্ট স্কলার ড. মুহাম্মাদ মুস্তফা আজমি (মৃ. ২০১৭ খ্রি.) উরওয়ার রচিত পুস্তিকার শেষ অংশই উদ্ধার করতে সক্ষম হন। এটি আবুল আসওয়াদ মিসরির বর্ণনায় পাওয়া যায় এবং ১৯৮১ সালে সৌদি আরবের রিয়াদ থেকে মাগাজি রসুলিল্লাহ স. লি-উরওয়াহ ইবনি জুবাইর বি-রিওয়াতি আবিল আসওয়াদ নামে প্রকাশিত হয়।

ওয়াহাব ইবনে মুনাববিহের রচনার একটি অংশ জার্মানির হাইডেলবার্গে সংরক্ষিত আছে। ইবনে শিহাব জুহরির রচনা থেকে ২ হাজার পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন ড. মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ আওয়াজি, যা ২০০৪ সালে মারাউইয়্যাত আল ইমাম জুহরি ফিল মাগাজি নামে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়।

সর্বপ্রাচীন পূর্ণাঙ্গ সিরাতগ্রন্থ

ইবনে ইসহাক (মৃ. ১৫১ হিজরি) রচিত সিরাতে ইবনে ইসহাক সবচেয়ে পরিচিত। আবদুল মালিক ইবনে হিশাম (মৃ. ২১৮ হিজরি) এটির ভিত্তিতে সিরাতে ইবনে হিশাম রচনা করেন। তবে মুসা ইবনে উকবা (মৃ. ১৪১ হিজরি) রচিত সুবিশাল আল-মাগাজি এর আগেই তৈরি হয়েছিল এবং এটি এখনো অক্ষত আছে। এছাড়া ‘মুআম্মার ইবনে রাশেদ’ (মৃ. ১৫১ হিজরি) রচিত আল-মাগাজি এর কপি আজকাল খুবই দুর্লভ।

ইবনে ইসহাকের জন্ম ৮৫ হিজরি এবং মৃত্যু ১৫১ হিজরি, আর মুসা ইবনে উকবার জন্ম ৬৮ হিজরি এবং মৃত্যু ১৪১ হিজরি। তাই কেবল অস্তিত্বের দিক থেকে হিসাব করলে মুসা ইবনে উকবার আল-মাগাজি সর্বপ্রাচীন পূর্ণাঙ্গ সিরাতগ্রন্থ।

আধুনিক যুগের বিচিত্র রচনা: ইসলামের ইতিহাসের এমন কোনো পণ্ডিত খুঁজে পাওয়া ভার, যিনি নবীজীবনের ওপরে কলম ধরেননি। কারও কারও রচনা কলেবরে এতটাই বিরাট আকার ধারণ করেছে যে তা কয়েক হাজার পৃষ্ঠা ছাড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশে ‘সিরাত বিশ্বকোষ’ রচিত হয়েছে। আবার কেউ কেউ নবীজীবনের ওপর আরবি ভাষায় বিরাট কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। মহানবী (সা.)–এর জীবদ্দশাতেও তাঁকে নিয়ে অনেক প্রশস্তিমূলক কাব্য রচিত হয়েছে বটে, তবে তা জীবনী আকারে ছিল না। ১২ হিজরি শতকে মাসউদ ইবনে মুহাম্মাহ আল-ফাসি (মৃ. ১১১৯ হি.) প্রথম কাব্যজীবনী রচনা করেন। গ্রন্থের নাম দেন ‘নাফাইসুদ দুরার ফি আখবারি সাইয়িদিল বাশার’। এরপর একইভাবে আহমদ বুখারি দিময়াতি (মৃ. ১৮৯২ ইং) রচিত ‘সাআদাতুত দারাইন’ এবং ইউসুফ ইসমাইল নাবহানি (মৃ. ১৯৩২ ইং) লেখেন ‘আন-নাজমুল বাদি ফি মাওলিদিশি শাফি’। বাংলা ভাষায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘মরুভাস্কর’ লিখেছেন। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে। মহানবী (সা.)–এর জীবনী নিয়ে চারটি পর্বে ১৮টি খণ্ড-কবিতা নিয়ে রচিত হয়েছে এই কাব্যগ্রন্থ।

আধুনিক যুগে আরবি ভাষার অন্যতম সিরাতগ্রন্থ হলো নাসিরুদ্দিন আলবানি (মৃ. ১৯৯৯ ইং) রচিত ‘সহিহ আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা’, ভারতের বিখ্যাত দায়ি আবুল হাসান আলী নদভি (মৃ. ২০০০ ইং) রচিত ‘আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা’; যা বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বাংলা ভাষায় এর অনুবাদ ‘নবীয়ে রহমত’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। সফিউর রহমান মোবারকপুরির (মৃ. ২০০৬ ইং) ‘আর রাহীকুল মাখতুম’ আরবি বইটি ১৯৭৯ সালে রাবেতায়ে আলাম আল ইসলামি আয়োজিত প্রথম উন্মুক্ত সিরাত গ্রন্থ প্রতিযোগিতায় ১১৮৭টি পাণ্ডুলিপির মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে। এটিকে সিরাতসংক্রান্ত বিশাল সংগ্রহশালার একটি নির্যাসগ্রন্থ বলা যায়। মিসরীয় চিন্তাবিদ মুহাম্মাদ আল গাজালি (মৃ. ১৯৯৬ ইং) রচনা করেন সিরাতবিষয়ক একটি বিশ্লেষণগ্রন্থ ‘ফিকহুস সিরাহ’। একই নামে সিরিয়ান শায়খ রামাদান আল-বুতিরও (মৃ. ১৯৯৬ ইং) একটি রচনা রয়েছে। এ ছাড়া আরবি ভাষায় লিখিত সিরাতের মধ্যে সাইয়েদ সোলাইমান নদভির ‘আস-সিরাতুন নাবাবিয়া’, শায়খ সালেহ আল মুনাজ্জিদ ‘খুলুকুন আজিম’ ও আলী সাল্লাবির ‘আসসিরাতুন নাবাবিয়া আরজু ওয়াকায়ি ওয়া তাহলিলিল আহদাস’ উল্লেখযোগ্য।

উর্দু ভাষায় অমুসলিমদের রচনাবলির মধ্যে বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ হলো ইন্ডিয়া পত্রিকার সম্পাদক গুরু দত্ত সিং দারা (G S Dara) লিখিত ‘রসুলে আরাবি’, যা আবু তাহের মেছবাহ কর্তৃক ‘তোমাকে ভালোবাসি হে নবী’ শিরোনামে বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। উর্দু ভাষায় রয়েছে ভারতের শিক্ষাবিদ মাওলানা আবুল কালাম আজাদের ‘রসুলে রহমত’ ও শিবলী নুমানির ‘সিরাতুন নাবী’। ইংরেজি ভাষার আলোচিত সিরাতগ্রন্থগুলো মধ্যে মার্টিন লিংগসের ‘Muhammad: His Life Based on the Earliest Sources’, জামাল বাদাবির ‘Muhammad A Blessing For Mankind’, ওয়াহিদুদ্দিন খানের ‘Prophet of Revolution’, হোসাইন হায়কলের ‘Muhammad Rasulallah’, মোহাম্মদ হামিদুল্লাহর ‘Muhammad Rasulullah: A concise survey of the life and work of the founder of Islam’, সাইয়েদ হোসাইন নাসেরের ‘Muhammad, Man of God’, আদিল সালাহির ‘Muhammad: man and prophet, a complete study of the life of the Prophet of Islam’, ফেতুল্লাহ গুলেনের ‘The Messenger of God: Muhammad’ ও তারিক রামাদানের ‘The Messenger: the Meanings of the Life of Muhammad’ উল্লেখযোগ্য।

নবীজীবনী রচনার ধারাবাহিকতা

বাংলা ভাষাতেও মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর জীবনকথা বহুবার অনূদিত হয়েছে। এরপরই আসে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইবনে ওমর আল-ওয়াকিদির (মৃ. ৩৪৬ হি.) আত-তারিখ ওয়াল মাগাজি, যিনি সাধারণত ‘ওয়াকিদি’ নামে পরিচিত। মদিনায় জন্মগ্রহণ করা এই পণ্ডিতের গ্রন্থ নিয়ে কিছু বিতর্কও লক্ষ্য করা গেছে।

চতুর্থ হিজরি শতকে জারির ইবনে তাবারির (মৃ. ৩১০ হি.) আত-তারিখ ওয়াল উমাম এবং আলী ইবনে হুসাইন মাসউদির (মৃ. ৩৪৬ হি.) মুরুজু আজ-জাহাব রচিত হয়। পঞ্চম শতকে ইবনে হাজম (মৃ. ৪৫৬ হি.) জাওয়ামিউস সিরাহ, ষষ্ঠ শতকে আবদুর রহমান সুহাইলি (মৃ. ৫৮১ হি.) রওজুল উনফ, সপ্তম শতকে ইমাম নববির (মৃ. ৬৭৬ হি.) তাহজিবুস সিরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ প্রকাশিত হয়।

অষ্টম শতকে তিনটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো— ইমাম জাহাবির (মৃ. ৭৪৮ হি.) আল-মাগাজি, ইবনুল কাইয়্যিম জাওজির (মৃ. ৭৫১ হি.) জাদুল মাআদ, এবং ইবনে কাসিরের (মৃ. ৭৭৪ হি.) আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া। এর মধ্যে জাদুল মাআদ বাংলাদেশে ছয় খণ্ডে বাংলা অনুবাদ হয়েছে।

নবম হিজরি শতকে আহমদ ইবনে আলী মাকরিজি (মৃ. ৮৪৫ হি.) ইমতাউল আসমা বিমা লিররসুলি মিনার আবনা এবং ইবনে হাজার আসকালানি (মৃ. ৮৫২ হি.) মুখতাসারুস সিয়ার প্রকাশ করেন। দশম শতকে শিহাবুদ্দিন কাসতালানি (মৃ. ৯২৩ হি.) রচনা করেন আল-মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যা। এগারো শতকে আল্লামা বুরহানুদ্দিন হালাবি (মৃ. ১০৪৪ হি.) ইনসানুল উয়ুন ফি সিরাতিল আমিনিল মামুন লিখে ‘সিরাতে হালাবিয়া’ নামে পরিচিতি পান।

তবে, মুসলিম বিশ্বের শিক্ষালাভ ও সাহিত্যচর্চার প্রধান মাধ্যম ছিল আরবি, তাই অধিকাংশ রচয়িতা আরবি ভাষায় লিখেছেন।

আধুনিক যুগের রচনাবলি

সিরাতের আধুনিক রচনায় লেখকদের রচনা বিশাল হয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশে সিরাতসংক্রান্ত বিশ্বকোষ ও কব্যগ্রন্থও রচিত হয়েছে। ১২ হিজরি শতকে মাসউদ ইবনে মুহাম্মাহ আল-ফাসি নাফাইসুদ দুরার ফি আখবারি সাইয়িদিল বাশার নামে কাব্যজীবনী রচনা করেন।

পরবর্তীতে আহমদ বুখারি দিময়াতি (মৃ. ১৮৯২ ইং) সাআদাতুত দারাইন, ইউসুফ ইসমাইল নাবহানি (মৃ. ১৯৩২ ইং) আন-নাজমুল বাদি ফি মাওলিদিশি শাফি লিখেছেন। বাংলা ভাষায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৫১ সালে মরুভাস্কর প্রকাশ করেন, যা চার পর্বে ১৮টি খণ্ড-কবিতার মাধ্যমে নবীজীবনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে।

আধুনিক আরবি সিরাতগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য— নাসিরুদ্দিন আলবানি (মৃ. ১৯৯৯) সহিহ আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা, আবুল হাসান আলী নদভি (মৃ. ২০০০) আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা (বাংলা অনুবাদ: নবীয়ে রহমত)। সফিউর রহমান মোবারকপুরির (মৃ. ২০০৬) আর রাহীকুল মাখতুম ১৯৭৯ সালে সিরাত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করে।

মিসরীয় চিন্তাবিদ মুহাম্মাদ আল গাজালি (মৃ. ১৯৯৬) ফিকহুস সিরাহ, সিরিয়ান শায়খ রামাদান আল-বুতি (মৃ. ১৯৯৬) একই নামে গ্রন্থ রচনা করেছেন। আরবি সিরাতের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ লেখক— সাইয়েদ সোলাইমান নদভি আস-সিরাতুন নাবাবিয়া, শায়খ সালেহ আল মুনাজ্জিদ খুলুকুন আজিম, আলী সাল্লাবি আসসিরাতুন নাবাবিয়া আরজু ওয়াকায়ি ওয়া তাহলিলিল আহদাস।

উর্দু ভাষায় উল্লেখযোগ্য রচনাকার— গুরু দত্ত সিং দারা (G S Dara) রসুলে আরাবি (বাংলা অনুবাদ: তোমাকে ভালোবাসি হে নবী), মাওলানা আবুল কালাম আজাদ রসুলে রহমত, শিবলী নুমানি সিরাতুন নাবী।

ইংরেজি ভাষায় জনপ্রিয় সিরাতগ্রন্থ— মার্টিন লিংগস Muhammad: His Life Based on the Earliest Sources, জামাল বাদাবি Muhammad A Blessing For Mankind, ওয়াহিদুদ্দিন খান Prophet of Revolution, হোসাইন হায়কল Muhammad Rasulallah, মোহাম্মদ হামিদুল্লাহ Muhammad Rasulullah: A concise survey of the life and work of the founder of Islam, সাইয়েদ হোসাইন নাসের Muhammad, Man of God, আদিল সালাহী Muhammad: man and prophet, a complete study of the life of the Prophet of Islam, ফেতুল্লাহ গুলেন The Messenger of God: Muhammad, তারিক রামাদান The Messenger: the Meanings of the Life of Muhammad।

ঊনবিংশ শতকের শুরুতে প্রাচ্যবিদদের রচনায় বেশ কিছু জীবনীগ্রন্থের নাম উঠে আসে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাতে মহানবী (সা.)–কে উপস্থাপন করার চেয়ে তাঁকে আক্রমণ করা হয়েছে বেশি। ফিলিপ কে হিট্টি আরবি ভাষা ও সাহিত্যের একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত। তাঁর রচিত ‘ইসলাম অ্যান্ড দ্য ওয়েস্ট’ গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন ‘ইসলাম ইন ওয়েস্টার্ন লিটারেচার’। তিনি দেখিয়েছেন, ১৬৪৯ সালে সিউর ডিউ রায়ার কোরআনের ফারসি তরজমা প্রকাশ করেন। তার সঙ্গে মহানবী (সা.)–এর সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য যুক্ত করে Alcoran of Mahomet নামে প্রকাশ করেন। এই Mahomet হলো মুহাম্মদ (সা.)–এর বিকৃত রূপ। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে একই নামের ৪১টি রূপের সন্ধান পাওয়া যায়।

এরপর ১৭৩৬ সালে ভলতেয়ার ‘মাহোমেত’ নামে একটি পাঁচ অঙ্কের প্রহসন রচনা করেন; যার পুরো শিরোনাম: Le fanatisme, ou Mahomet le Prophete (ধর্মান্ধতা বা মাহোমেত নবী)। নাটকের মাহোমেত [মুহাম্মদ (সা.)] চরিত্রটি ধর্মান্ধ, যে তাঁর সমালোচকদের হত্যার আদেশ দেয় এবং ‘পালমিরা’ নামে এক মেয়ের প্রেমে মত্ত হয়। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সেন্ট হেলেনাতে বন্দী থাকাকালে এই নাটকের কঠোর সমালোচনা করেন। ভলতেয়ার তাঁর বক্তব্য পরিবর্তন করেন এবং বলেন, ‘তিনি [মুহাম্মদ (সা.)] অবশ্যই খুব মহান ব্যক্তি ছিলেন এবং তিনি মহান মানুষদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। ছিলেন বিজয়ী বিধানদাতা, প্রজ্ঞাবান ও নেতা। সাধারণ মানুষের চোখে তিনি পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছেন।’

১৮৩০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের একজন পূর্বপুরুষ রেভারেন্ড জর্জ বুশ এ এম (১৭৯৬-১৮৫৯) লেখেন ‘The Life of Mohammed : Founder of the Religion of Islam and of the Empire of the Saracens’। কিসিঞ্জার লিগেছি রিপ্রিন্ট ১৮৩৩ সালে তা পুনঃপ্রকাশ করে এবং নতুন করে ২০০২ সালে লন্ডনে আবার ছাপা হয়। ১৮৪৩ সালে জার্মান প্রাচ্যবিদ গুস্তাফ ওয়েইল লেখেন ‘Mohammed der Prophet, sein Leben und seine Lehre’, ১৮৫১ সালে অস্ট্রিয়ান প্রাচ্যবিদ স্প্রেঙ্গার লেখেন ‘Aloys Sprenger, The Life of Mohammad, from Original Sources’, ১৮৫৮ সালে স্কটিশ লেখক উইলিয়াম মুর ৪ খণ্ডে লিখেছেন ‘The Life of Muhammad and History of Islam to the Era of the Hegira’। তবে ১৯৪৭ সালে আর ভি সি বোদলে লিখিত বিখ্যাত ‘The Messenger: the Life of Mohammed’ গ্রন্থটি বেশ প্রশংসা অর্জন করে, খ্যাতিমান স্কলার আলী নদভিসহ পরবর্তীকালের সিরাত গ্রন্থকারগণ এই গ্রন্থের রেফারেন্স ব্যবহার করেন। এমন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হলো উইলিয়াম মন্টোগোমেরি ওয়াট রচিত Muhammad at Mecca ও Muhammad at Medina.

নবীজীবনী রচনার আধুনিক ও পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি

ঊনবিংশ শতকের শুরুতে পশ্চিমা প্রাচ্যবিদদের রচনায় মহানবী (সা.)–কে উপস্থাপনার পরিবর্তে প্রায়ই সমালোচনামূলক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তবে এর মধ্যে কয়েকজন পণ্ডিত সম্মানজনক বিশ্লেষণও করেছেন। ফিলিপ কে হিট্টি ইসলাম অ্যান্ড দ্য ওয়েস্ট গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ১৬৪৯ সালে সিউর ডিউ রায়ার কোরআনের ফারসি অনুবাদ প্রকাশ করেন এবং সংক্ষেপে নবীজীবনের বিবরণ যুক্ত করে Alcoran of Mahomet নামে প্রকাশ করেন। “Mahomet” হলো মুহাম্মদ (সা.)–এর বিকৃত রূপ।

১৭৩৬ সালে ভলতেয়ার Le fanatisme, ou Mahomet le Prophete রচনা করেন, যেখানে নবীজীবনকে নাট্য রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে পরে তিনি তার বক্তব্য সংশোধন করে নবীজীকে প্রজ্ঞাবান ও মহান নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেন।

১৮৩০ সালে মার্কিন রেভারেন্ড জর্জ বুশ The Life of Mohammed: Founder of the Religion of Islam and of the Empire of the Saracens রচনা করেন। এরপর ১৮৪৩ সালে জার্মান প্রাচ্যবিদ গুস্তাফ ওয়েইল, ১৮৫১ সালে অস্ট্রিয়ান প্রাচ্যবিদ স্প্রেঙ্গার, ১৮৫৮ সালে স্কটিশ লেখক উইলিয়াম মুর এবং ১৯৪৭ সালে আর ভি সি বোদলে নবীজীবন ভিত্তিক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। একই ধরনের নির্ভরযোগ্য গবেষণা হিসেবে আছে উইলিয়াম মন্টোগোমেরি ওয়াটের Muhammad at Mecca ও Muhammad at Medina।

উর্দু ভাষায় অমুসলিম লেখকরা যেমন গুরু দত্ত সিং দারা রসুলে আরাবি এবং স্বামী লক্ষ্মণ প্রসাদ আরব কা চান্দ লিখেছেন। পরে বাংলা অনুবাদ ও প্রকাশনায় এই রচনাগুলো আলোড়ন সৃষ্টি করে।

বাংলা ভাষায় নবীজীবনী রচনার সূচনা

বাংলায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভরযোগ্য জীবনী রচনার credit মেলে রেভারেন্ড জেমস লংকে। তিনি ১৮৮৫ সালে মুহাম্মদের জীবনচরিত্র প্রকাশ করেন। একই সময়ে অতুল কৃষ্ণমিত্র ধর্মবীর মুহাম্মদ, কৃষ্ণ কুমার মিত্র মুহাম্মদ চরিত্র ও মুসলমান ধর্মের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, গিরিশ চন্দ্র সেন মহাপুরুষ মুহাম্মদের জীবনচরিত লিখেছেন।

১৯০৪ সালে রামপ্রাণ গুপ্ত হজরত মুহাম্মদ ও হজরত আবু বকর, ১৯৪২ সালে নাবিয়া অ্যাবট Aishah: the beloved of Mohammed, এবং ১৯৮৫ সালে অ্যানেমারি শিমেল And Muhammad Is His Messenger প্রকাশিত হয়। এইসব গ্রন্থ ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাস ও নবীজীবনকে বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করে।

মুসলিমদের লেখা আধুনিক বাংলা সিরাত

মুসলিম লেখকরা বাংলা ভাষায় নবীজীবনী রচনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হলো:

শেখ আবদুর রহীম, ১৮৮৭: হযরত মুহম্মদের স. জীবনচরিত ও ধর্মনীতি

ডা. সৈয়দ আবুল হোসেন, ১৯০৮: মোসলেম পতাকা

শেখ মোহাম্মদ জমীর উদ্দীন, ১৯১৫: মাসুম মোস্তফা (সা.)

এয়াকুব আলী চৌধুরী, ১৯২২: মানব মুকুট

মোবিনুদ্দীন আহমদ জাহাঙ্গীর নগরী, ১৯২৫: নবীশ্রেষ্ঠ

গোলাম মোস্তফা, ১৯৪২: বিশ্বনবী

খান বাহাদুর আবদুর রহমান খাঁ, ১৯৪৯: শেষ নবী

মাওলানা আবদুল খালেক, ১৯৫১: ছাইয়েদুল মুরছালীন

মুহাম্মদ বরকতুল্লাহ, ১৯৬০: নবী গৃহ সংবাদ

মাওলানা মুহাম্মদ তফাজ্জল হোসাইন, ১৯৬৮: হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) সমকালীন পরিবেশ ও জীবন

কবি আল মাহমুদ, মুহাম্মদ নূরুল হুদা এবং আবদুল মান্নান সৈয়দও নবীজীবনী ভিত্তিক গ্রন্থ লিখেছেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গবেষক নাসির হেলাল ২০০৫ সালে বাংলায় ১০২৮টি নবীজীবনী গ্রন্থের তালিকা প্রকাশ করেছেন।

নারী সিরাত রচনার অবদান

নারীদের লেখা সিরাতগ্রন্থ আধুনিক সময়ে বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। উল্লেখযোগ্য লেখিকারা: ক্যারেন আর্মস্ট্রং (ইংল্যান্ড): Muhammad: A Biography of the Prophet (১৯৯১), Muhammad: A Prophet For Our Time (২০০৬)। নাবিয়া অ্যাবট (আমেরিকা): Aishah: the beloved of Mohammed (১৯৪২)

অ্যানেমারি শিমেল (জার্মানি): And Muhammad Is His Messenger (১৯৮৫)।

সারা তাইফুর (বাংলাদেশ): স্বর্গের জ্যোতি (১৯১৬), বাংলা একাডেমি সংস্করণ (১৩৭১ বাংলা সন)

খাদিজা আক্তার রেজায়ি: তিনি চাঁদের চেয়েও সুন্দর ।

মাসুদা সুলতানা রুমি: আমি বারোমাস তোমায় ভালোবাসি (২০০৯)

মাজিদা রিফার: মহানবী (২০১৯)

সকল যুগ ও দেশ ধরে নবীজীবনী রচনার ধারা অবিরাম। কবির কথায়—নবীর প্রশংসা কখনো শেষ হয় না, অনন্তকাল ধরে শব্দশিল্পীরা তাঁর গুণগান বয়ে নিয়ে যায়।

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন