মঙ্গলবার
৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
মঙ্গলবার
৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বেগম খালেদা জিয়া

১৯৪৫–২০২৫ এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি 

এনপিবি ডেস্ক
প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৫২ এএম
খালেদা জিয়া
expand
খালেদা জিয়া

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর চেয়ারপারসন ও দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আর নেই। মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) ভোর ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার আবির্ভাব ছিল একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত। ১৯৮১ সালে স্বামী, সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর সৃষ্ট রাজনৈতিক বাস্তবতা তাকে ঘরোয়া জীবনের সীমা পেরিয়ে সরাসরি জাতীয় রাজনীতির মূল স্রোতে নিয়ে আসে। যিনি ছিলেন একজন সাধারণ গৃহিণী, তার জীবনের গতিপথ যে এমন নাটকীয় মোড় নেবে—তা হয়তো তিনি নিজেও কখনো ভাবেননি।

বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নির্বাচিত নারী সরকারপ্রধান। তিনি ১৯৯১ সাল থেকে তিন দফায় দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তার জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুর জেলায়। পিতা ইস্কান্দার মজুমদার ও মাতা তৈয়বা মজুমদারের সন্তান খালেদা জিয়ার পারিবারিক শিকড় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ফেনী জেলায়। দেশভাগের পর তার বাবা ভারতের জলপাইগুড়ি থেকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে চলে আসেন।

শিক্ষাজীবনে তিনি দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন এবং পরবর্তীতে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৯৬০ সালে তিনি তৎকালীন সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে বেগম খালেদা জিয়া দেশের ফার্স্ট লেডি হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। এ সময় তিনি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার, নেদারল্যান্ডসের রানি জুলিয়ানা-সহ বিশ্বনেতাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে অংশ নেন।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি তিনি বিএনপিতে সাধারণ সদস্য হিসেবে যোগ দেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তার নেতৃত্বগুণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৮৩ সালে তিনি দলের ভাইস-চেয়ারপারসন এবং ১৯৮৪ সালে বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।

১৯৮২ সালে সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে সামরিক শাসন জারি হলে বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি সাতদলীয় জোট গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৬ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের বিরোধিতা করে তিনি নির্বাচন বর্জন করেন। এ সময় রাজনৈতিক চাপ ও আন্দোলনের কারণে তাকে একাধিকবার কারাবরণ করতে হয়—১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সাতবার তাকে আটক করা হয়েছিল।

তার নেতৃত্বে বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল দেশব্যাপী শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তোলে। দেশের অধিকাংশ ছাত্র সংসদে তাদের বিজয় এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনে বড় ভূমিকা রাখে। আপসহীন মনোভাবের কারণে আশির দশকে তিনি “আপসহীন নেত্রী” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার শাসনামলে বাংলাদেশ আবার সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসে। অর্থনীতিতে নানা সংস্কার শুরু হয় এবং কর্মসংস্থান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়, যেখানে বিপুল সংখ্যক নারী শ্রমবাজারে যুক্ত হন।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। জাতিসংঘে গঙ্গার পানি বণ্টনের বিষয়টি তুলে ধরে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যার দাবি জানান। ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে হোয়াইট হাউসে তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করেন। এর ফলশ্রুতিতে মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

১৯৯৬ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। একই বছরের জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হলেও সংসদে ১১৬টি আসন নিয়ে দেশের ইতিহাসে বৃহত্তম বিরোধী দলে পরিণত হয়।

১৯৯৯ সালে তার নেতৃত্বে চারদলীয় জোট গঠিত হয়। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অঙ্গীকার নিয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি আবার ক্ষমতায় আসেন। নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়নে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৫ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন তাকে বিশ্বের প্রভাবশালী নারীদের তালিকায় ২৯তম স্থানে স্থান দেয়।

২০০৬ সালে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে তৎকালীন সরকারের সময় দুর্নীতির অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, যা তার সমর্থকদের মতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল।

তার সরকারের সময়ে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও বিনামূল্যে করা হয়, মেয়েদের জন্য দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা ফ্রি করা হয় এবং শিক্ষা উপবৃত্তি চালু হয়। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো এবং শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ তার শাসনামলের উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত।

একটি ব্যতিক্রমী রেকর্ডও তার নামে রয়েছে—তিনি কখনো কোনো নির্বাচনী আসনে পরাজিত হননি। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচনে একাধিক আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবগুলোতেই জয়ী হন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বেগম খালেদা জিয়া থাকবেন এক সাহসী, সংগ্রামী ও প্রভাবশালী নেত্রী হিসেবে—যার জীবন কেবল ক্ষমতার গল্প নয়, বরং আন্দোলন, ত্যাগ ও দৃঢ়তার এক দীর্ঘ অধ্যায়।

google news সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

X