


বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন। কোটি কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় এই নেত্রী আজ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক অসুস্থতা তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর মোহনায়। তিনি এখন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। তার অবস্থা মুমূর্ষু। তিনি আজ বড় বেশি অসহায়। অসুখ মানেই সুখ নেই।
তার অসুখ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় প্রহর কাটছে দেশবাসীর। খালেদা জিয়ার জন্য দোয়া চাইছেন তারা, দলমত নির্বিশেষে দাঁড়িয়েছেন তার পাশে ঠিক যেমন ১৯৮১ সালের ৩০ মে’র পর গোটা বাংলাদেশ দাঁড়িয়েছিল তার শহীদ স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কফিনের সামনে।
খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে অনন্য ইতিহাস সৃষ্টিকারী একটি নাম। আমরা তাকে যেভাবেই দেখি না কেন, ডানে ঝুঁকে কিংবা বাঁয়ে বেঁকে সবদিক থেকেই তিনি এক এবং অতুলনীয়। জেল-জুলুম, নির্যাতন-নিপীড়ন কখনো তাকে অবদমিত করতে পারেনি। নিজ দল বিএনপিকে তিনি ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করেছেন বারকয়েক।
শুধু তা-ই নয়, একাধিকবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন দলটিকে। খালেদা জিয়া তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন দেশ ও দেশের মানুষের সঙ্গে।
এ কারণে ওয়ান-ইলেভেনের মতো চরম দুর্দিনেও দেশ ছাড়তে রাজি হননি তিনি। আশির দশকের প্রথমার্ধে বিএনপির হাল ধরে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে দাঁড় করান সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি মূল্যবোধকে অবিভাজ্য সম্মিলনের মধ্য দিয়ে তিনি এগিয়ে নিয়ে যান বিএনপিকে।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ঘটে অসাধারণ ঘটনা। রাজনীতিতে তিনি ধারাবাহিকভাবে ধরে রাখেন সফলতা। সংগঠিত করেন জনগণকে। তিনি নিজে স্বপ্ন দেখেন এবং স্বপ্ন দেখান তার অনুগামীদের। নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে নেতৃত্ব দেন এরশাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ছিল জিয়ার কালজয়ী দর্শন। এই দর্শনকে সামনে রেখে খালেদা জিয়া জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বাতিঘর হিসেবে আবির্ভূত হন।
খালেদা জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির চেয়ারপারসন টানা ৪২ বছর ধরে। জাতীয় রাজনীতিতে ১৯৮২ থেকে ২০২৫ সাল দীর্ঘ চার দশকেরও অধিক সময়কালের সাক্ষী তিনি। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে খালেদা জিয়া আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন তার নেতৃত্ব।
বিএনপির নেতাকর্মীদের চোখে খালেদা জিয়া একজন আপসহীন দেশনেত্রী। দল ও সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে বহুবার তিনি মোকাবিলা করেছেন চরম সংকট ও ক্রান্তিকাল। যদিও রাজনীতিতে তার অভিষেক সাধারণ গৃহবধূ থেকে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বরণের পর পাল্টে যায় খালেদা জিয়ার জীবনধারা।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি বাধ্য হন বিএনপির হাল ধরতে। আনুষ্ঠানিকভাবে দলটির সদস্যপদ গ্রহণ করেন ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি। চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন ১৯৮৪ সালের ১০ মে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাতবার গৃহবন্দি হন খালেদা জিয়া। ওয়ান-ইলেভেন ও হাসিনার আমলে মিথ্যা মামলায় দু’বার গ্রেপ্তার হয়ে কারাবাস করেন। জুলাই অভ্যুত্থানের পর কারামুক্ত হন তিনি।
খালেদা জিয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরাবরই ছিলেন অপরাজেয়। চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ছয়টি জেলা থেকে ১৮টি আসনে নির্বাচন করে জয়ী হন সবকটি আসনেই। ১৯৯১ সালে পঞ্চম, ১৯৯৬ সালের জুনে সপ্তম এবং ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম সংসদ নির্বাচনে পাঁচটি করে আসনে জয়লাভ করেন তিনি।
২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ তিনটি আসনে প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হন খালেদা জিয়া। এই নির্বাচনে প্রথমবারের মতো একজনের প্রার্থিতা সীমিত করা হয় তিনটি আসনে। অপরদিকে শেখ হাসিনা ১৯৯১ সালে দুটি এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে একটি আসনে পরাজিত হন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এভাবেই সবাইকে ছাড়িয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছান খালেদা জিয়া। জাতীয় নেতৃত্বের আসনে সুদৃঢ় করেন তার অবস্থান ও ভাবমূর্তি। ২০১৮ সালে কারান্তরীণ হওয়ার পর খালেদা জিয়া নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন রাজনীতিতে। এ অবস্থায় পুত্র তারেক রহমান দায়িত্ব নেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মোড় ঘুরে যায় দেশের রাজনীতির। শুরু হয় আওয়ামী দুঃশাসন। জিয়া পরিবার ও বিএনপির ঘাড়ে চেপে বসে স্বৈরশাসনের দৈত্য। গুম, খুন, অপহরণ ও মিথ্যা মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে বিএনপির রাজনীতির ভিত। বড় সন্তানের নির্বাসন এবং ছোট সন্তানের মৃত্যুশোকে মুহ্যমান খালেদা জিয়া চেষ্টা করেন ঘুরে দাঁড়াতে।
তার আগেই ফ্যাসিস্ট হাসিনা তাকে মিথ্যা মামলায় নিক্ষেপ করেন কারাগারে। এর মাঝেই ঘাতক ব্যাধি বাসা বাঁধে তার দেহে। বারবার অনুমতি চেয়েও সুযোগ মেলেনি বিদেশে চিকিৎসার। আজকের তার এই বিপন্নপ্রায় জীবনের জন্য দায় নিতে হবে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকেও।
আপসকামী হলে খালেদা জিয়া হয়তো অনেক বিপদ এড়াতে পারতেন, নির্বিঘ্ন হতো তার জীবন চলার পথ। কিন্তু দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সে পথে হাঁটেননি তিনি। অনন্য নেতৃত্বের গুণাবলিই আজকে তাকে আসীন করেছে মহীয়সী নারীর আসনে।
অশীতিপর খালেদা জিয়া দীর্ঘস্থায়ী গুরুতর শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন। অন্যান্য জটিলতার পাশাপাশি সম্প্রতি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে তার হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসে। ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসকরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছেন তাকে। তার দেহের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি অঙ্গ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত ঘাতক ব্যাধিতে, বিশেষ করে রয়েছে লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, ফুসফুস ও কিডনির সমস্যা, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস ও বার্ধক্যজনিত জটিলতা।
কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত হন তিনি। এসব কারণে বারবার তাকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে হাসপাতালে। অন্যের সাহায্য ছাড়া স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছেন না তিনি। তাকে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে ফেলে লিভার সিরোসিস।
এর থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রয়োজন ছিল তার দেহে স্থায়ী লিভার প্রতিস্থাপন। বাংলাদেশে এই চিকিৎসার সুযোগ না থাকায় প্রয়োজন ছিল তাকে বিদেশে নেওয়ার। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময় তাকে লন্ডন নেওয়া হলেও বয়স ও অন্যান্য জটিলতার কারণে লিভার প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়নি।
গত ৭ জানুয়ারি থেকে ৫ মে পর্যন্ত লন্ডনে ছিলেন তিনি। হার্টের মারাত্মক সমস্যায়ও ভুগছেন খালেদা জিয়া। ২০২৪ সালের জুনে পেসমেকার সংযোজন করা হয়েছে তার হার্টে। ইলেকট্রনিক এই ডিভাইসটি তার হৃৎকম্পন স্বাভাবিক রাখছে। তার হার্টের তিনটি ব্লকের মধ্যে একটিতে রিং পরানো আছে।
দীর্ঘস্থায়ী আর্থ্রাইটিস সম্প্রতি ভয়াবহ জটিলতা সৃষ্টি করেছে তার দু’হাতে। গত ২১ নভেম্বর সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে তার দু’হাতের অস্বাভাবিক স্ফীতি ও বিকল অবস্থা দেখে শিউরে উঠেছেন প্রত্যক্ষদর্শী অতিথিরা।
রাজনীতিতে আসার আগে খালেদা জিয়া ছিলেন অনেকটাই নিভৃতচারী। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে স্বামীর সাহচর্য ছাড়া কোথাও দেখা যেত না তাকে। জিয়ার শাহাদাত বরণের পর দু’সন্তান নিয়ে কঠিন দুঃসময় পার করেন তিনি। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে নারী নেতৃত্বের আসন যারা অলংকৃত করেছেন, তিনি তাদের অন্যতম।
খালেদা জিয়াই বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯৩ সালে সার্কের প্রথম মহিলা চেয়ারপারসনও নির্বাচিত হন তিনি। বাকসংযমী ও রাজনৈতিকভাবে দূরদর্শী খালেদা জিয়া মানুষের কথা শোনেন আগ্রহভরে। খালেদা জিয়ার আত্মবিশ্বাস, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাধারা অগণিত মানুষের আস্থাভাজন করে তোলে তাকে।
একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশের বহু ঘটনার নীরব সাক্ষী তিনি। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থা রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধানমন্ত্রীশাসিত এবং বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যায়। এমন একজন নেত্রীকে তার ৩৭ বছরের ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে নির্মমভাবে উচ্ছেদ করা হয় সপরিবারে।
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে এই কাজ করেন শেখ হাসিনা। দল ও সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি যে ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে ছিলেন, এমনটি নয়। অনেক সীমাবদ্ধতাও ছিল তার জীবন ও কর্মে। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান পারিবারিক রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে সফল হলেও তার প্রতিষ্ঠিত বিএনপিতে সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেননি তার উত্তরসূরিরা।
জিয়া অনেকটা এড়িয়ে চলতেন আত্মীয়-স্বজনকে। জিয়া পরিবারের দ্বিতীয় পুরুষ তারেক রহমান বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পান ২০০২ সালে। পরে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন নিযুক্ত হন। বিএনপিতে জিয়ার নিজ পরিবারের তেমন কেউ রাজনীতিতে নেই।
কিন্তু খালেদা জিয়ার পরিবারের অনেকেই ফুলটাইম রাজনীতি করছেন বিএনপিতে। কিন্তু নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ থেকে তিনি বিচ্যুত হয়েছেন -এমন অভিযোগ ওঠেনি কখনো। খালেদা জিয়ার বিরল দেশপ্রেম ও নেতৃত্ব রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে মর্যাদাশীল করেছে বিশ্বদরবারে। অন্তিম সময়ে তার প্রতি দেশবাসীর ভালোবাসা আরো গভীরতর হয়েছে।
খালেদা জিয়া স্বার্থপরতা পরিহার করে নিজেকে নিবেদিত করেন সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে। দেশ ও জাতির অনাগত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার চিন্তা-চেতনা পাথেয় হয়ে থাকবে রাষ্ট্র বিনির্মাণে।
জীবনের খানিকটা আকাশ শূন্যতার পরিবৃত্তে সীমিত থাকে প্রত্যেকেরই। হয়তোবা খালেদা জিয়ারও রয়েছে শূন্যতা, যা তখনই পূর্ণতা পাবে যদি তিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সার্থকতা দেখে যেতে পারেন। মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে সুস্থ করে তুলবেন -এটাই আমাদের কাম্য।
লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, নিউ ইয়র্ক
মন্তব্য করুন